একাধিক সমবায় সমিতির বিরুদ্ধে জঙ্গি অর্থায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ মেলার পরও সেই সমবায় সমিতিগুলোই এবার সরাসরি রাজনৈতিক মাঠ দখলের মিশনে নেমেছে। এ লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নাম সর্বস্ব নতুন দল গঠন করে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। এ ছাড়া সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে পরিচিত জামায়াতে ইসলামীর প্রতীক ও নিবন্ধন বাতিল করার পরও ইসলামের নাম ব্যবহার করে ইসির নিবন্ধন পেতে তদবির চালাচ্ছে আরো কিছু দল। অথচ এদের কোনোটির ইসি ঘোষিত দল নিবন্ধনের শর্ত প্রতিপালনের সুযোগ নেই।
নির্বাচন কমিশনের শর্তানুযায়ী নতুন কোনো রাজনৈতিক দলকে ইসির নিবন্ধন পেতে হলে ওই দলের সারাদেশের ৬৪ জেলার ২২টিতে অফিস, ৪৯১ উপজেলার মধ্যে ১০০টি অফিস এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ে প্রতিটি কমিটিতে ২০০ জন ভোটার সদস্য থাকা বাধ্যতামূলক। সেই সঙ্গে দলের পক্ষে কমপক্ষে একজন কোনো এক সংসদে এমপি হিসেবে থাকতে হবে। এই শর্তের কোনো একটিতে ত্রুটি থাকলে ওই দল নিবন্ধনে অযোগ্য হবে।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালে ১/১১ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পর নির্বাচনকালীন এই সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত তিন সদস্যের কমিশনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ড. শামসুল হুদা ও অপর দুই কমিশনার মোহাম্মদ ছহুল হোসাইন ও ব্রি. জে. (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের-১৯৭২ (আরপিও) পাশাপাশি নির্বাচনে তারা আমূল সংস্কার আনেন। একই সঙ্গে, নামসর্বস্ব শতাধিক রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে প্রার্থী বেচা-বিক্রি ঠেকাতে নিবন্ধনের শর্ত আরোপ করে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বিধিমালা প্রণয়ন করে। প্রণীত বিধিমালার আলোকে সব দলকে স্থায়ী নিবন্ধনের বিধান চালু হয়। এখন ৪২টি রাজনৈতিক দল ইসির নিবন্ধন পেয়েছে। তবে, যুদ্ধপরাধীর অপরাধে জামায়াত এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার অন্যতম আসামি ফারুকের দল ফ্রিডম পার্টির নিবন্ধন কার্যক্রম স্থগিত। বাকি ৪০ দলের নিবন্ধন রয়েছে।
সূত্রমতে, আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের স্বীকৃতির জন্য অনিবন্ধিত দলগুলো আবেদন জানাতে পারবে। এ পর্যন্ত ১৫টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য ইসিতে আবেদন জানিয়েছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো নতুন দল আবেদন জানাচ্ছে। নির্ধারিত সময়ের আগে আরো অনেক দল আবেদন জানাবে বলে মনে করছেন ইসির কর্মকর্তারা। ইসি কর্মকর্তারা জানান, আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায়, এমন একগুচ্ছ অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নিবন্ধন পেতে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে। নানা নামে আবেদন জানাচ্ছেন তারা। লক্ষ্য নিবন্ধন নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থীদের বিরুদ্ধে লড়াই করা।
জানা গেছে, এ পর্যন্ত ১৫টি দল ইসিতে আবেদন জানিয়েছে। এগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি, শরীয়াহ আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ ইউনাইটেড ইসলামী পার্টি, আম জনতা খেদমত পার্টি, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদ ও স্মৃতি পাঠাগার, তৃণমূল বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জনতা পার্টি (বিজেপি-ওসমানী), ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ লেবার পাটি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল কংগ্রেস, বাংলাদেশ তৃণমূল কংগ্রেস, বাংলাদেশ পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিপিডিপি), ভাসানী ন্যাপ ও মৌলিক বাংলা। আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দল হিসেবে কমিশনের নিবন্ধনের জন্য নামসর্বস্ব এসব দলের দৌড়ঝাঁপ চলছে। দল নিবন্ধনের জন্য আবেদনের হিড়িক পড়েছে ইসিতে। কোনো ধরনের তদবির না থাকলে গতকাল পর্যন্ত আবেদন করা একটি দলও ইসির নিবন্ধনের শর্তপূরণ করতে পারবে না বলে মনে করছেন ইসির সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চায় ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদ ও স্মৃতি পাঠাগার’ নামে একটি রাজনৈতিক দল যারা নিজেদের বঙ্গবন্ধুর দল হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। দলটির দাবি, সারাদেশের জেলা-উপজেলায় এমনকি তৃণমূল পর্যায়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের কার্যক্রম রয়েছে। রয়েছে জেলা ও উপজেলায় অফিস-কমিটি। আবেদনকারী এসএম হেলাল আহম্মেদ নিজেকে দলের স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক দাবি করে বলেন, সমবায় থেকে তাদের এই দলের নিবন্ধন নেয়া আছে। এখন ইসির নিবন্ধন পাওয়ার জন্য সেখান থেকে আবেদন ফরম সংগ্রহ করা হয়েছে। দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম সম্পর্কে হেলাল জানান, সারাদেশের সর্বত্রই তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম চলছে। দেশের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে তাদের অফিস নেই। অবশ্য কোনো কোনো জেলা এবং উপজেলায় তাদের অফিস আছে তা আর জানাতে পারেননি তিনি।
নিবন্ধন নিতে আসা বাংলাদেশ জনতা পার্টি (বিজেপি-ওসমানী) নামে আরেকটি দলের সাধারণ সম্পাদক মো রফিকুল ইসলামর সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, আমাদের দলটি অনেক পুরনো এবং ৩০ জেলায় কমিটি রয়েছে। ১৯৭৮-৭৯ সালে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দলের প্রতিষ্ঠাতা ওসমানী বিপুল ভোট পেয়েছিলেন। অনেকদিন দলের কার্যক্রম পরিচালিত না হওয়ায় আমরা পিছিয়ে পড়েছি। সবার সহযোগিতা পেলে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করতে পারব। ঢাকায় তাদের অফিস মোনা টাওয়ারে বলে দাবি করেন এই নেতা। এই দলটির কার্যক্রম সম্পর্কেও কোনো ইতিবাচক তথ্য পাওয়া যায়নি। আর নতুন দল মৌলিক বাংলার ফরিদ আহমেদ বলেন. আমাদের যোগ্যতা রয়েছে, এখন ইসি তাদের যোগ্যতা মূল্যায়ন করে নিবন্ধন দেয় কিনা এটাই দেখার বিষয়।
ইসির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মূল ধারার দলগুলোর নিবন্ধন পাওয়ার পর এখন যত দলই ইসিতে আবেদন করছে প্রত্যেকটি দলই ‘নামসর্বস্ব’। এক কথায় বলা যায়, এক নেতা এক দল। কারণ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনএফ নিবন্ধনের অযোগ্য হয়েও বিশেষ একটি সংস্থার চাপে বিদায়ী রকিবউদ্দিন কমিশন দলটিকে নিবন্ধন দিতে বাধ্য হয়। পরে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন করে বিএনএফের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ এমপি নির্বাচিত হন। এই দলটির একক নেতা আবুল কালাম।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন