চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে একই পরিবারের ১১ জনকে পুড়িয়ে হত্যার আলোচিত ঘটনার ১৪ বছর আজ। এ ঘটনায় হওয়া মামলার কার্যক্রম গত পাঁচ বছর থমকে আছে।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, মূল আসামি উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও কালীপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান চৌধুরীর আবেদনে উচ্চ আদালত ২০১২ সালে স্থগিতাদেশ দেন। এরপর চট্টগ্রাম জেলা তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলাটি চলমান থাকলেও আসামিপক্ষের বারবার সময় আবেদন এবং মূল আসামির স্থগিতাদেশে মামলাটির আইনি গতি থমকে আছে। মামলার মূল আসামির স্থগিতাদেশ উচ্চ আদালত বাতিল না করায় চলমান মামলার সাক্ষীরাও সাক্ষ্য দিতে আসছে না।
হাজিরা দিতে না যাওয়ার কারণ জানিয়ে সাক্ষীরা বলছেন, মূল আসামির বিচারপ্রক্রিয়া স্থগিত রেখে মামলায় সাক্ষ্য প্রদান সম্পূর্ণ মামলার গতিপ্রকৃতি পাল্টে যেতে পারে। তাই তাঁরা সাক্ষ্য দিচ্ছেন না। মূল আসামির বিচারপ্রক্রিয়া স্থগিতাদেশ বাতিল হলে তাঁরা অবশ্যই সাক্ষ্য দেবেন।
চট্টগ্রাম জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এ কে এম সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘সাক্ষীদের নামে সমন ও ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হলেও সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আসছেন না। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে মাত্র একজন মহিলা সাক্ষ্য দিয়েছেন। একজন আসামির বিচারপ্রক্রিয়া উচ্চ আদালতে স্থগিতাদেশ রয়েছে।
তা বাতিল করার জন্য আবেদন করেছি। উচ্চ আদালত ওই আসামির স্থগিতাদেশ বাতিল করলে মামলাটির বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত শেষ হবে। ’
মামলার বাদী ডা. বিমল শীল বলেন, ‘মামলার বিচার চেয়ে বহু বছর কষ্ট করেছি। বিচার পাচ্ছি না। গত পাঁচ বছর ধরে মামলাটির সাক্ষ্য প্রদান বন্ধ রয়েছে। ’ তিনি বলেন, ‘ওই ঘটনার মূল হোতা জামিনে এসে প্রকাশ্যে ঘুরছে। সরকারি কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে বিভিন্ন সরকারি সভায় নানামুখী বক্তব্য দিচ্ছে। ’ মূল আসামি এখন সাক্ষীদের নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
মামলার বাদী আরো বলেন, ‘আমি মামলা চালাতে গিয়ে অর্থকষ্টে ভুগছি। এ মামলাটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে চালানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রীসহ সরকারি দপ্তরগুলোতে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু কিছুই হয়নি। ’
অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আমিনুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘আমি ১১ হত্যায় জড়িত ছিলাম না। পুনঃ তদন্তের মাধ্যমে আমাকে চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করায় আমি শুধু আমার বিচারপ্রক্রিয়াটি স্থগিতের আবেদন করেছি। ওই মামলায় আমি কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার করছি না। এ অবস্থায় বিচারপ্রক্রিয়া চলতে পারে। ’
মূল আসামি এখন আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছেন—এমন অভিযোগের ব্যাপারে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল গফুর বলেন, ‘১১ হত্যা মামলাটির দ্রুত বিচার সম্পন্ন করতে বাদীকে আরো উদ্যোগী হতে হবে। কালীপুর সাবেক চেয়ারম্যান একজন বিএনপি নেতা। তাঁকে আওয়ামী লীগ কখনো প্রশ্রয় দেয়নি এবং দেবেও না। ’
প্রসঙ্গত, ২০০৩ সালের ১৮ নভেম্বর রাতে বাঁশখালীর সাধনপুর গ্রামের শীলপাড়ার তেজেন্দ্র লাল শীলের বাড়িতে আগুন দিয়ে একই পরিবারের ১১ জনকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় বেঁচে যাওয়া পরিবারের একমাত্র সদস্য বিমল শীল থানায় মামলা করেন।
নিহতরা হলেন তেজেন্দ্র লাল শীল (৭০), বকুল বালা (৬০), অনিল কান্তি শীল (৪২), স্মৃতি রানী শীল (৩০), সোনিয়া শীল (৭), রুমী শীল (১১), বাবুটি শীল (২৫), প্রসাদী শীল (১৭), এ্যানী শীল (১৫), দেবেন্দ্র শীল (৭০) ও চার দিন বয়সী কার্তিক শীল।
সাধনপুরের পোড়া বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, নিহতদের মধ্যে ৯ জনের সমাধি বাড়ির প্রবেশমুখেই। পোড়া বাড়ির শূন্য ভিটাটিতে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিফলক, যেখানে নিহত ১১ জনের নামফলক লাগানো রয়েছে। অপরিচিত কেউ পোড়া বাড়িতে গেলেই আশপাশের মানুষ আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়ে।
সেদিনের ঘটনায় তিন মেয়েকে হারিয়েছেন মামলার দুই নম্বর সাক্ষী শচীন্দ্র শীল। তিনি বলেন, ‘রাতের আঁধারে ঘটে যাওয়া এই ন্যক্কারজনক ঘটনায় আমার তিন মেয়েকে হারিয়েছি। ওই ঘটনার আদৌ বিচার হবে কি না দুশ্চিন্তায় আছি। ’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন