ক্যানসার আক্রান্ত কুমিল্লার দাউদকান্দি থানার বাসিন্দা আবুল খায়েরকে রেডিওথেরাপি দিতে ১২ নভেম্বর সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ক্যানসার বিভাগে আনেন স্বজনরা। সেখানে হাজির হওয়ার পর জানতে পারেন রেডিওথেরাপি মেশিনটি প্রায় এক মাস ধরে নষ্ট; একথা জানার পর স্বজনরা রোগী আবুল খায়েরকে নিয়ে ফিরে যান। আবুল খায়েরের মতো অসংখ্য ক্যানসার রোগী চিকিৎসা না নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে প্রতিদিনই ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। শুধু ক্যানসার চিকিৎসার মেশিনই নয়, বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ের মেশিন নষ্ট থাকায় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় চিকিৎসালয়ে আসা রোগীদের।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দুই হাজার ৩০০ শয্যা রয়েছে। অবশ্য প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার রোগী চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকেন। তবে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগীদের বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয় যন্ত্রপাতি নষ্ট থাকায়। বর্তমানে হাসপাতালটির ক্যানসার বিভাগের যন্ত্রপাতি নষ্ট। এ ছাড়া নষ্ট রয়েছে রেডিওলজি বিভাগের এক্স-রে ও সিটিস্ক্যান মেশিনও। হাসপাতালের আন্তঃবিভাগে বহিরাগত ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কর্মচারীদের উৎপাতও রয়েছে। এসব সমস্যা মোকাবিলা করে চিকিৎসা পেতে রোগীদের ভোগান্তির শেষ নেই। সম্প্রতি হাসপাতাল ঘুরে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে।
ঢামেক হাসপাতালের ক্যানসার বিভাগের এক কর্মচারী জানান, হাসপাতালটির ক্যানসার বিভাগের নিচতলায় একটি লিনিয়ার এক্সিলারেটর মেশিন রয়েছে। হাসপাতালের ১৯ নম্বর ও ২০ নম্বর কক্ষে রয়েছে একটি করে কোবাল্ট-৬০ মেশিন। ১৯ নম্বর কক্ষের কোবাল্ট-৬০ মেশিনটি দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট; কক্ষটি বাইরে থেকে তালাবদ্ধ। ২০ নম্বর কক্ষের কোবাল্ট মেশিনটির সোর্স পুরনো হয়ে যাওয়ায় সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে কিছুদিন আগে। সব মিলিয়ে হাসপাতালের ক্যানসার বিভাগের যে তিনটি মেশিন ছিল, তার সবই নষ্ট।
ওই কর্মচারী আরও জানান, চলতি বছরের জুলাই মাসের পর প্রথম দিকে লিনিয়ার এক্সিলারেটর মেশিন বিকল হয়। প্রায় দুই মাস বিকল থাকার পর প্রায় পৌনে এক কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে মেরামত করা হয়। মেশিন মেরামতের এক মাস না যেতেই ফের বিকল হয়ে যায়। এবারও প্রায় এক মাস ধরে মেশিনটি বন্ধ। ক্যানসার বিভাগের তিনটি মেশিন নষ্ট থাকায় যেসব রোগী আসছেন, তারা ফিরে যাচ্ছেন। থেরাপি দেওয়ার মেশিন নষ্ট থাকায় ব্রেকিথেরাপি মেশিনটিও ঠিকমতো ব্যবহার করা যাচ্ছে না। কারণ ক্যানসারে আক্রান্তদের রেডিওথেরাপি দেওয়ার পরই ব্রেকিথেরাপি দেওয়া হয়। ওই মেশিনগুলো কাজ না করায় ব্রেকিথেরাপির রোগীও কম। একটি মেশিন অচল থাকায় অপর সচল মেশিনটিও কাজে লাগছে না।
ব্রেকিথেরাপি মেশিন রুমে (নিচতলার ১০ নম্বর) গিয়ে দেখা গেল টেকনোলজিস্ট নেই। রুমটিতে আড্ডা দিচ্ছেন হাসপাতালের কয়েক কর্মচারী। এক কর্মচারী জানান, ব্রেকিথেরাপি চিকিৎসা দেওয়া হয় জরায়ু ক্যানসারে আক্রান্ত মহিলাদের। এই চিকিৎসা গ্রহণের আগে তাদের রেডিওথেরাপি নিতে হয়। বর্তমানে হাসপাতালের একমাত্র লিনিয়াক ও দুই কোবাল্ট মেশিনসহ তিনটি মেশিনই নষ্ট। ফলে কর্মচারীরা অলস সময় পার করছেন।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. কাজী মুস্তাক হোসেন বলেন, ক্যানসার বিভাগের লিনিয়ার এক্সিলারেটর মেশিন মেরামত হচ্ছে। আশা করছি আগামীকাল চালু করা যাবে। তিনি বলেন, কোবাল্ট মেশিন দুটি নষ্ট। হাসপাতালের জন্য একটি কোবাল্ট মেশিন বরাদ্দ হয়েছে। আশা করি নতুন কোবাল্ট মেশিন আগামী এক মাসের মধ্যে পাওয়া যাবে।
হাসপাতালের নাক, কান ও গলা বিভাগের অধ্যাপক এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি ডা. আবু ইউসুফ ফকির বলেন, নাক, কান ও গলা বিভাগের অনেক রোগীর অস্ত্রোপচারের পর ক্যানসার শনাক্ত হয়। ক্যানসার রোগীর বেশিরভাগেরই রেডিওথেরাপির প্রয়োজন পড়ে। রেডিওথেরাপি নিতে পাঠানো হয় ক্যানসার বিভাগে। কিন্তু সেখানকার মেশিন নষ্ট থাকায় অন্য কোনো সরকারি হাসপাতালে যেতে হয়। অন্য হাসপাতালে রোগীরা সহজে সিরিয়াল পান না। আবার নামি-দামি বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসাব্যয় বেশি। হাসপাতালে একসঙ্গে সব মেশিন নষ্ট থাকলে রোগীদের কেমোথেরাপি চিকিৎসা নিতে হয়। চিকিৎসকরাও রেডিওথেরাপি না দিতে পেরে কেমোথেরাপি দিচ্ছেন।
চিকিৎসকরা জানান, সরকারি হাসপাতালে একবার থেরাপি নিতে কোবাল্ট-৬০ মেশিনের জন্য ১০০ টাকা এবং লিনিয়ার এক্সিলারেটর মেশিনের জন্য ২০০ টাকা দিতে হয়। একজন রোগীকে সর্বোচ্চ ৩০-৩৫টি থেরাপি নিতে হয়। সরকারি হাসপাতালের তুলনায় প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর থেরাপির চার্জ অনেক বেশি হওয়ায় দরিদ্র রোগীরা প্রাইভেট হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পারেন না। ফলে অনেকেই বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোল্লাহ ওবায়েদুল্লাহ বাকী বলেন, দেশে প্রায় ১৫ লাখ ক্যানসার রোগী রয়েছেন। প্রতিবছর প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ নতুন করে শনাক্ত হচ্ছে। ক্যানসার আক্রান্তদের ৭০ শতাংশ রোগীকে দিতে হয় রেডিওথেরাপি। এর বড় একটি অংশ দরিদ্র। যাদের একমাত্র চিকিৎসার স্থান সরকারি হাসপাতাল। দেশের নয়টি সরকারি হাসপাতালে রেডিওথেরাপি মেশিন রয়েছে ১৬টি। এর মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তিনটি। সরকারি হাসপাতালের ক্যানসার চিকিৎসা দেওয়ার মেশিন নষ্ট থাকলে আর্থিকভাবে অসচ্ছল রোগীরা প্রত্যাশিত চিকিৎসাসেবা পান না।
সিটিস্ক্যান ও এমআরআই বিকল: রেডিওলজি বিভাগের দুটি সিটিস্ক্যান ও নতুন ভবন (হাসপাতাল-২) একটি সিটিস্ক্যানসহ মোট তিনটি সিটিস্ক্যান, তিনটি এমআরআই, পাঁচটি এক্স-রে মেশিন রয়েছে। এর মধ্যে রেডিওলজি বিভাগের একটি সিটিস্ক্যান মেশিন নষ্ট রয়েছে প্রায় দুই মাস এবং নতুন দুটি এমআরআই মেশিন সচল থাকলেও পুরনো এমআরআই মেশিন নষ্ট দেড় বছর ধরে। ছয় মাস ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে এক্স-রে মেশিন। রেডিওলজি বিভাগের এক টেকনোলজিস্ট জানান, প্রতিদিন দুটি সিটিস্ক্যান মেশিনে ১২০ থেকে ১৫০, দুটি এমআরআই মেশিনে ২৫-৩০ জন এবং এক্স-রে মেশিনে ৬০০-৭০০ রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। রেডিওলজি বিভাগে যে সংখ্যক রোগীর চাপ তাতে আরও মেশিন প্রয়োজন। এর মধ্যে একটি সিটিস্ক্যান, একটি এমআরআই ও একটি এক্স-রে মেশিন নষ্ট থাকায় রোগীদের সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেকে লম্বা সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে থেকে কর্তৃপক্ষের গুষ্টি উদ্ধার করেন। এ ছাড়া রোগীর স্বজন ও কর্মচারীদের মধ্যে প্রায়ই বাগ্্বিত-া হয়।
হাসপাতাল নয় যেন বাজার: ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনে (হাসপাতাল-২) মেডিসিন ওয়ার্ড। মেডিসিন ওয়ার্ডের শয্যা সংখ্যা ৬০০ হলেও রোগীর সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। মেডিসিন ওয়ার্ডে প্রবেশ করলে প্রথমেই মনে হবে এটি কোনো হাসপাতাল নয়, যেন বাজার। হাসপাতালের পাঁচতলা থেকে সাততলা পর্যন্ত সিঁড়ি, লিফট, করিডর, চিকিৎসক ও নার্সের রুমের ফাঁকা জায়গায় পাটি বা কাপড় বিছিয়ে শুয়ে আছেন রোগীরা।
ওয়ার্ডমাস্টার রিয়াজ জানান, মেডিসিন বিভাগের আওতাধীন শয্যা সংখ্যা ৬০০; কিন্তু রোগী আছেন প্রায় দেড় হাজার। এ অবস্থায় যে যেখানে পারছেন থাকছেন। এসব রোগীকে সামাল দেওয়ার মতো কর্মচারীও নেই। ফলে হযবরল অবস্থা বিরাজ করছে।
বাধ্য হয়ে রোগীদের বাইরে পাঠানো হচ্ছে: ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা থাকলেও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের হাসপাতালের বাইরের ডায়াগনিস্টিক সেন্টারে রোগনির্ণয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। এমনকি রোগীর ফাইলে রোগনির্ণয় পরীক্ষা লেখার পর চিকিৎসক নিজেই ডায়াগনিস্টিক সেন্টারের লোকজনকে ডেকে আনছেন রোগীর নমুনা নিতে। চিকিৎসকের কথামতো বাইরের ডায়াগনিস্টিক সেন্টার থেকে পরীক্ষা না করালে চিকিৎসক রোগীর স্বজনের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছেন এমন অভিযোগ করেন কেউ-কেউ। কোনো কোনো সময় হাসপাতাল থেকে করানো রিপোর্ট ছুড়ে ফেলে বাইরের ডায়াগনিস্টিক সেন্টার থেকে রোগনির্ণয় পরীক্ষার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।
হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, ১০-১২টি ডায়াগনিস্টিক কোম্পানির লোকজন রোগনির্ণয় পরীক্ষার ব্যবসা গেড়ে বসেছেন হাসপাতালটিতে। কোনো চিকিৎসক রোগীর ব্যবস্থাপত্রে রোগনির্ণয় পরীক্ষা লিখে তাদের পছন্দের ডায়াগনিস্টিক সেন্টারে যেতে পরামর্শ দেন। আবার কোনো চিকিৎসক নিজে পরামর্শ না দিলেও তার ঘনিষ্ঠ কর্মচারী রোগীর স্বজনকে কোথায় পরীক্ষা করাবে তার একটি নিদের্শেনা দিচ্ছেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন