ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই বাংলাদেশে পাকিস্তানের নিপীড়ন বাড়তে থাকে। সেই সাথে বাড়তে থেকে মিছিল-সমাবেশ। মিছিল সমাবেশ হলেই সেখানে প্রয়োজন হতো মাইকের। আর ’৫২ পরবর্তী সময়ে প্রতিবাদ আন্দোলনের প্রতিটি ধাপে কল-রেডি মাইক সার্ভিস জড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হিসেবে।
১৯৭১-এর সেই অগ্নিঝরা উত্তাল সময়ে কল-রেডি মাইক সার্ভিস ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হয়েও শুধুমাত্র দেশের স্বার্থে সেবা দিয়ে গেছে। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন এই কল-রেডির মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে। স্থান ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এছাড়া এই কল-রেডির মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন স্বাধীনতা পরবর্তীকালের জাতীয় নেতৃবৃন্দ।
.
আজ সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাবার ৭ই মার্চের ভাষণ ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়ায় আয়োজিত নাগরিক সমাবেশে ভাষণ দিয়েছেন।ইতিহাসের আরেকটি অধ্যায়ের সাক্ষী হলো কল-রেডি।
বিক্রমপুরের শ্রীনগর থানার মঠবাড়িয়া গ্রামের সহোদর দুই ভাই দয়াল ঘোষ ও হরিপদ ঘোষ। পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে মাইকের ব্যবসা শুরু করলেন। প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল আই এম অলওয়েজ রেডি, অন কল এট ইয়োর সার্ভিস বা আরজা (এআরজেএ) অথবা ‘আরজু’ ইলেক্ট্রনিকস।বছরখানেক পরই নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘কল-রেডি’। মূলত লাইটিং, সাজসজ্জা ভাড়া দিতো আরজু ইলেক্ট্রনিক্স।বিয়ে-শাদিতে লাইটের সঙ্গে গ্রামোফোনও ভাড়া নিতো লোকজন। দোকানটি পরিচিত হয়ে ওঠে অল্প দিনেই। সেই সাথে চাহিদাও বাড়তে থাকে। চাহিদা অনুযায়ী জোগান দিতে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে কয়েকটি মাইক নিয়ে আসেন। কিন্তু তা দিয়েও চাহিদা পূরণ হচ্ছিল না।। মাইকের কারিগরি জানা থাকায় হরিপদ ঘোষ নিজেই যন্ত্রপাতি কিনে কয়েকটি হ্যান্ডমাইক তৈরি করেন।
১৯৪৮ সালে দেশ ভাগের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা মাইক ভাড়া নিতে শুরু করেন আরজু লাইট হাউস থেকে। চাহিদা বাড়তে থাকে দিনে দিনে। তাই তাইওয়ান, জাপান ও চীন থেকে আনা হয় মাইক। তবে মাইকের মূল অংশ মানে ইউনিট বেশি আনা হতো বাইরে থেকে। এরপর নিজের দোকানের কারিগর দিয়ে হরিপদ ঘোষ তৈরি করতেন বাকি অংশ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর থেকে সভা-সমাবেশ বাড়তে থাকে এবং সামাজিক আর ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রয়োজনেও মাইকের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। তাই মাইক সার্ভিসের সাথে মিল রেখে ‘কল-রেডি’নামটিই ঠিক করা হয়। প্রয়োজনে কল করলেই যেন মাইক রেডি থাকে।অর্থাৎ কল করলেই রেডি- কল-রেডি।
৭ই মার্চ কল-রেডিতে উচ্চা্রিত হলো ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ বঙ্গবন্ধুর শ্বাস-প্রশ্বাসে দুলছিল কল-রেডির মাইক্রোফোন, কাঁপছিল মাইকগুলো।
আজ আবারো এই কল-রেডির মাইক্রোফোন আর মাইকেই উচ্চারিত হলো বঙ্গবন্ধুর কথা। বাংলার কথা। সাধারণের কথা। শুধু উপলক্ষ ভিন্ন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন