ব্যাংকিং খাতে জাল-জালিয়াতির ঘটনা বেড়ে গেছে ভয়ানকভাবে। মারাত্মক আকার ধারণ করেছে খেলাপি ঋণ। এ খাতে অনিয়মই হয়ে পড়েছে যেন নিয়ম। এসব অনিয়মে নিচের স্তরের কর্মচারী থেকে শুরু করে ব্যাংকের মালিকরা পর্যন্ত জড়িয়ে পড়ছে। এসবের প্রমাণ থাকলেও রাজনৈতিক চাপের কারণে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে ব্যাংকব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
সূত্র জানায়, আগে রাজনৈতিক চাপ শুধু সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন এ চাপ বেসরকারি ব্যাংকগুলোয়ও সংক্রমিত হয়েছে। ফলে বেসরকারি ব্যাংকগুলোও ফোকলা হয়ে পড়েছে। ঋণ বিতরণে বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনা সরকারি সোনালী, বেসিক ব্যাংকে বেশি হয়েছে। অগ্রণী, জনতা, রূপালী, কৃষি ব্যাংকেও হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু ব্যাংকিং খাতের জড়িতদের বিরুদ্ধে চাকরিচ্যুতির ব্যবস্থা নিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ঘটনার ব্যাপারে মামলা করলেও শাস্তির বিষয়টি এখনো ঝুলে আছে। এ ঘটনা শুধু বেসিক, হলমার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের জালিয়াতির ক্ষেত্রে হয়েছে। এসব ঘটনার মূল নায়করা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এসব বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, ব্যাংকের কোনো ধরনের জালিয়াতির তথ্য পেলে তা সঠিকভাবে মনিটরের চেষ্টা করা হয়। তার পরও কিছু ব্যাংকে সুশাসনের অভিযোগ রয়েছে। সেসব ব্যাংকের বোর্ডকে এ বিষয়ে কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া আছে। তা ছাড়া যেসব ব্যাংক ঝুঁকির মধ্যে আছে, তা থেকে পরিত্রাণ পেতে কী করা যায়, তা নিয়ে প্রতিনিয়ত আলোচনা করা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্লিপ্ততায় কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদ দখল হওয়ার ঘটনা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই ফেঁসে গেছে। বিশেষ ব্যবস্থায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালক পদে পরিবর্তনকে কোনো রকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই রাতারাতি অনুমোদন নিতে বাধ্য হয় ওপর মহলের চাপে। পরে ব্যাংকের এমন রদবদলের কারণ জানতে চেয়ে ব্যাংকের অন্যতম শেয়ারহোল্ডার ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) থেকে চিঠি দেওয়া হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে। তদন্তে ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদের পরিবর্তন আনার বিষয়টি অনুমোদন করা বিধিসম্মত হয়নি বলে প্রমাণিত হয়। ফলে আইডিবিকে এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয়নি। এদিকে ইসলামী ব্যাংকের মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের যেখানে শেয়ার রয়েছে, সেখানে বিধিবহির্ভূতভাবে পরিচালক অনুমোদন করার বিষয়ে যেসব কর্মকর্তা ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পর্ষদের পরিবর্তনের পর ইসলামী ব্যাংকে ঋণ বিতরণে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এসব ঘটনা ক্ষতিয়ে দেখতে দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। একই সময় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায়ও পরিবর্তন আনা হয়।
ওই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই অক্টোবরে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন আনা হয়। এসব কারণে অন্য যেসব ব্যাংকের পরিচালকদের মধ্যে গ্রুপিং রয়েছে, ওই ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা আতঙ্কে রয়েছেন। এসব মিলে ব্যাংকিং খাতে এক ধরনের অস্থিরতা চলছে।
সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক তদারকি করে দুটি পদ্ধতিতেÑ একটি সরাসরি তদন্ত বা অনসাইট সুপারভিশন এবং অপরটি হচ্ছে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনার মাধ্যমে তদারকি বা অফসাইট সুপারভিশন। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শকরা যেখানে গিয়ে হাত দিচ্ছেন সেখানেই নানা অনিয়ম পাচ্ছেন। এগুলো গণমাধ্যমে চলে আসায় ব্যাংকিং খাতের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছেÑ এমন অভিযোগে পরিদর্শকদের ক্ষমতা কমানো হয়েছে। আগে পরিদর্শকরা অভিযোগের ভিত্তিতে বিভাগের প্রধানের অনুমতি নিয়েই তদন্ত করতে পারতেন। এখন সেটি পারছেন না। ওপরের অনুমোদন নিতে হচ্ছে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভিজিল্যান্স ও বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন বিভাগকে অকেজো করে রাখা হয়েছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগ থেকেও বড় ধরনের কোনো তদন্ত হচ্ছে না। সব অভিযোগ রাখা হচ্ছে ফাইলবন্দি করে। ফলে তদন্তের মাধ্যমে তদারকি কার্যক্রম এখন অনেক শিথিল।
অফসাইট সুপারভিশনে যেসব সুপারিশ দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোর আলোকে ব্যাংকগুলোয় নানা চাপের কারণে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া যাচ্ছে না। কিছু ক্ষেত্রে দিলেও ব্যাংক সেগুলো কার্যকর করছে না। ফলে এদিক থেকেও সুপারভিশন ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেকের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ থাকলেও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত পরিচালকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ফলে পরিচালকরা বেপরোয়া গতিতে ব্যাংকগুলোর ওপর হস্তক্ষেপ করে নিজেদের বেআইনি সুবিধা আদায় করে নিচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থনীতির স্বার্থে ঋণের সুদের হার প্রয়োজনমাফিক কমাতে পারছে না। যদিও আমানতের সুদের হার অনেক কমে গেছে। এতে আমানতকারীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। কিন্তু এর বিপরীতে ঋণের সুদহার কমেনি। ফলে অর্থনীতি উপকৃত হচ্ছে না। আমানতের সুদের হার কমায় সঞ্চয়ের মুনাফা থেকে গ্রাহকরা বঞ্চিত হলেও কর্মসংস্থান বেড়ে তাদের আয় বাড়েনি। ফলে দুই দিক থেকেই তারা বঞ্চিত।
এ ছাড়া চলতি ব্যয় মেটাতে ব্যাংকগুলো ঋণের সুদ থেকে আয় বাড়াতে পারছে না। ফলে তারা গ্রাহকের ওপর নানা ধরনের চার্জ ও কমিশন আরোপ করে আয় বাড়াচ্ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আমানতকারীরা। বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করতেও ব্যর্থ হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ঋণ বিতরণে বিভিন্ন অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে পর্যাপ্ত মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে ব্যাংকগুলো। ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে সরকারও প্রতিবছর শর্তসাপেক্ষে মূলধন ঘাটতি পূরণে টাকা দিচ্ছে। তার পরও অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না। এ ছাড়া দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অব্যবস্থাপনা ও তদারকির অভাবে ব্যাংকিং খাতে মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এতে সরকারি ব্যাংকগুলো মূলধন সংকটে পড়ছে। রাজনৈতিক চাপ ও ব্যাংকে অব্যবস্থাপনার কারণে মূলধন ঘাটতি বাড়ছে। আর এর খেসারত দিতে জনগণের ঘাড়ে করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, পুরো ব্যাংক খাতের পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণের কারণে যে পরিবর্তন হচ্ছে, তা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সম্প্রতি ব্যাংকগুলোর পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায় যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছে, তা চলতে থাকলে ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকদের আস্থায় চিড় ধরবে। এ ধরনের হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেবে। মনে রাখা উচিত, ১/১১-এর সময় ব্যাংকগুলোয় গ্রাহকদের হিসাব বিবরণী চাওয়ার হিড়িক পড়লে আমানতকারীরা ব্যাংকবিমুখ হয়ে পড়েন। তখন তারল্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। পরিস্থিতি সামাল দিতে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল। এসব বিষয় বিবেচনা করে ব্যাংকের মতো স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করার ক্ষেত্রে বিবেচনা করা উচিত।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন