জেলার তারাকান্দা উপজেলার বগিরপাড়া এলাকার এক নববধূর হাতের মেহেদি মুছে যাওয়ার আগেই তালাক দিলেন তার প্রভাবশালী স্বামী। কিন্তু তালাক দিয়েও শান্ত হয়নি স্বামীর পরিবার। পরে তারা সেই নববধূর বাড়ি-ঘরে তাণ্ডব চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করেন। এসময় নববধূর বাবা, মা ও বড় ভাইকে বেধরক পিটিয়ে গুরুতর আহত করে বর পক্ষের লোকজন।
মঙ্গলবার (২১ নভেম্বর ) বিকেলে উপজেলার কাকনী ইউনিয়নের বগিরপাড়া গ্রামে সাংবাদিকরা গেলে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য জানান এলাকাবাসী।
স্থানীয়রা জানান, গত ৩ মাস আগে বগিরপাড়া গ্রামের চাঁন মিয়ার মেয়ে কামরুন্নহারকে (১৯) প্রেম করে বিয়ে করেন পাশের গ্রামের হক মিয়া (২২)। তবে গ্রাম ২টি হলেও ছেলে-মেয়ের বাড়ির মাঝখানে রয়েছে ছোট একটি নদী। ছেলের বাড়ি থেকে নৌকা দিয়ে নদী পাড় হলেই মেয়ের বাড়ি। অর্থাৎ ২ পাড়ে দুই গ্রাম। বগিরপাড়া গ্রামের কামরুন্নাহার ও মাসকান্দা গ্রামের হক মিয়ার মধ্যে গড়ে উঠে দীর্ঘদিনের প্রেমের সম্পর্ক।
তারা আরও জানান, মেয়ে পক্ষের পরিবারটি অত্যন্ত গরীব আর ছেলে পক্ষের পরিবারটি অনেক ধনী। তাই এক পর্যায়ে মেয়েটিকে প্রেমের টানে ঘরছাড়া করে স্থানীয় একটি কাজী অফিসে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করে প্রেমিক হক মিয়া। ওই সময় বিয়ের কাবিন নামায় ৩ লাখ টাকা দেনমোহর ধার্য করা হয়।
অন্যদিকে নববধূ কামরুন্নাহার বুঝতে পারেনি গরীব ঘরে জন্ম নেয়াটাই ছিল তার বড় অপরাধ। তার হাতের মেহেদির রঙ মুছে যাওয়ার আগেই শুরু হয় তার উপর নির্যাতন। ফিল্মি স্টাইলে তার বিরুদ্ধে যড়যন্ত্রে মেতে উঠে শ্বশুর বাড়ির লোকজন। প্রেমের সম্পর্কের এই বিয়ে মেনে নেয়নি স্বামীর পরিবার।
কিন্তু সুকৌশলে কামরুন্নাহারের কাছ থেকে একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে ছেলে হক মিয়াকে অন্যত্র বিয়ে করান পরিবারটি। স্বামীর পক্ষ থেকে মেয়েটিকে জানানো হয় সে নাকি তালাক দিয়েছে। তবে কামরুন্নাহার এসব ঘটনার কিছুই জানেন না। তাকে ঘরে তোলা তো দূরের কথা বরং যেখানে রেখেছিল সেখান থেকেও বিতাড়িত করেছে হক মিয়ার অভিভাবকরা।
এদিকে গভীর ষড়যন্ত্রের নীল নকশাতেই গত বৃহস্পতিবার সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে বগির পাড়ায়। ঘরবাড়ি দোকানপাঠ ভাঙচুর করে সন্ত্রাসী তাণ্ডবলীলায় আতঙ্ক সৃষ্টি করে বাড়িতে থাকা গরু, ছাগলসহ ঘরের আসবাবপত্র লুট করে নিয়ে যায় ছেলের ভাইয়েরা।
নববধূর বড় ভাই আহত আইনুদ্দিন ব্রেকিংনিউজকে জানান, আমরা গরীব বলে ছোট বোনের জীবনটা এভাবে নষ্ট করে দিল। বোনের হাতের মেহেদির রঙ মুছে যাওয়ার আগেই তাকে তালাক দিয়ে দিল? কি দোষ করেছিল কামরুন্নাহার? প্রেম করাতো দোষের কিছু ছিল না। আমরা গরীব বলে এমনভাবে সম্মান নিয়ে টানাটানি করবে?
তারপরেও তারা থেমে থাকেনি। বর পক্ষের লোকজন আমাদের বাড়ি ঘর ভাঙচুর করেছে। ঘরে থাকা সব মালামাল লুট করে নিয়েছে। সংসার চলার একমাত্র জীবিকা নির্বাহ করার উপার্জন ক্ষমতা দোকান ঘরটি পর্যন্ত ভেঙে সব কিছু নিয়ে গেছে ছেলের ভাইয়েরা।
তিনি আরো জানান, তাদের ভয়ে গত কয়েকদিন ধরে গ্রাম ছাড়া। ছেলের লোকজন আমাদের হত্যার ভয় দেখিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বলেছে। এখন আমরা কোথায় যাব? গত কয়েকদিন ধরে বিচার চেয়ে গেলাম। কোনো বিচার পেলাম না। পরে বাধ্য হয়ে আমি নিজেই বাদী হয়ে তারাকান্দা থানায় একটি মামলা দায়ের করেছি। আমরা তাদের কঠিন বিচার চাই।
তিনি আরও জানান, এ হামলায় অংশ নেয় হক মিয়ার বড় ভাই মৃত সিদ্দিক মিয়ার ছেলে হীরা মিয়া (৪০), লাইক মিয়া ( ৩৮), বড় ভাই ফরহাদ মিয়া ( ৩০) মা মারাজী বেগম।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এই হামলায় নারীরাও সন্ত্রাসী বেশে অংশ নেয়। মারাজী বেগম নিজেই রাম দা নিয়ে দৌঁড়াতে থাকে। কামরুন্নাহারকে হত্যার হুমকি দিয়ে খুঁজতে থাকে। তার বৃদ্ধ বাবা চান মিয়াকে বেধরকম মারধর করে। বড় ভাই আইনউদ্দিনকে কুপিয়ে জখম করেছে।
তারাকান্দা থানার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ পরিদর্শক (এসআই) মনোরঞ্জন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে ঘটনার ৫ দিন পর নিরাপত্তাহীন অসহায় নববধূ কামরুন্নাহারের পাশে দাঁড়িয়েছেন উপজেলার কাকনী ইউপি চেয়ারম্যান মো. মশিউর রহমান রিপন। এসময় ইউপি মেম্বার তরিকুর রহমান খন্দকার, নিজাম উদ্দিন, মহিলা মেম্বার, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে চেয়ারম্যান নির্যাতিত পরিবারের খোঁজ নেন। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দেন।
অন্যদিকে ঘটনার কথা জানতে পেরেছেন তারাকান্দা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শারমিন সুলতানা। তিনি মোবাইল ফোনে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটি দুঃখজনক ঘটনা। একটি মেয়ের জীবন এভাবে বিপন্ন হয়ে যাবে সেটা হয় না।’
তিনি মঙ্গলবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। অসহায় কামরুন্নাহার যাতে আইনগত সহায়তা পায় সে ব্যাপারে সার্বিক সহযোগিতার ব্যবস্থা নিবেন বলেও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
মঙ্গলবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন তারাকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাজাহারুল ইসলাম। তিনি ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আসামিদের ধরার জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি দ্রুত আসামিদের ধরে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এটি অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ বলে মনে করি। এভাবে একটি অসহায় পরিবারের উপর হামলা ও একটি মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে। আসামিদের কিছুতেই ছাড় দেয়া যাবে না।’
অন্যদিকে ছেলের পক্ষ হয়ে একটি প্রভাবশালী মহল তদবিরে নেমেছে ঘটনাটিকে ধামাচাপা দিতে। আসামিরা হুমকি দিয়েছে, যত টাকা লাগে লাগুক। মেয়েকে (কামরুন্নাহার) ঘরে তুলে নিব না।
এ ব্যাপারে নববধূ কামরুন্নাহারের স্বামী হক মিয়া ঘটনার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘আমি আমার পরিবারের চাপের মুখে পরে দ্বিতীয় বিয়ে করেছি। তবে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নেইনি। আমি কামরুন্নাহারকে নিয়ে সংসার করতে চাই। কিন্তু আমার পরিবার এতে কোনোভাবেই রাজি নয়। তারাই হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেছে।’
হক মিয়ার বড় ভাই হীরা মিয়া ব্রেকিংনিউজকে জানান, মেয়ের পরিবারকে আমরা অনেক বুঝিয়েছি। আমাদের পরিবারের বউ সে হতে পারবেনা। ওরা গরীব। আমাদের একটা বংশ মর্যাদা আছে।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন