সুন্দরবনের আতঙ্ক দস্যুরা। এরা সুন্দরবনভিত্তিক জীবিকা নির্বাহকারীদের কাছে সাক্ষাত আজরাইল বললেও অত্যুক্তি হয় না। দস্যুদের ভয়ে সুন্দরবনের মানুষ যেমন আতঙ্কিত তেমনি দস্যুরাও আতঙ্কে থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভয়ে। এ ছাড়াও আছে নিজেদের মধ্যে অন্তঃদ্বন্দ্ব। এতে প্রায়ই প্রাণ ঝরে তাদের। এই প্রাণের মায়া সবারই আছে। সবাই ঘর-সংসার নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে চায়। তেমনি দস্যুরাও চায় স্বাভাবিক জীবন।
.
সুন্দরবনে দস্যুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে আলোকবর্তিকা হয়ে কাজ করছেন সংবাদকর্মী মহসিন উল হাকিম। যিনি বেসরকারি চ্যানেল যমুনা টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি। তার সাথে ক্যামেরা নিয়ে সুন্দরবনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত চষে বেড়িয়েছেন একাধিক ভিডিও জার্নালিস্ট। এদের মধ্যে অন্যতম সিনিয়র ভিডিও জার্নালিস্ট বায়েজিদ ইসলাম পলিন।
এসব দুস্যুদের খুব কাজ থেকে দেখেছেন ভিডিও জার্নালিস্ট বায়েজিদ ইসলাম পলিন। এবার তার মুখেই শোনা যাক সুন্দরবনের দস্যুদের জীবন কাহিনী। তাদের হিংস্রতা, সুখ-দুঃখ আর নানা রোমহর্ষক ঘটনা। সেই সব দিনের অভিজ্ঞতার কথা বললেন তিনি। তার কথার চুম্বক অংশ তুলে ধরেছেন পরিবর্তন ডটকমের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এ এইচ এম ফারুক। চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের এটি হলো তৃতীয় পর্ব।
মাইকে ঘোষণার সাথে সাথে গুলি! চালাল কে?
যেহেতু ‘আত্মরক্ষাই সর্বোত্তম পন্থা’ সেহেতু মাস্টারই আগে গুলি চালিয়েছে। শুরু হলো দুই পক্ষের গোলাগুলি। প্রায় ২০ মিনিটের মতো গোলাগুলি চলল। এর মধ্যে যেভাবেই হোক সাংবাদিক আহসান রাজীব আমাদের কাছে এসে পৌঁছালেন।
গুলি হচ্ছে আর আমরা বনের ভেতর দৌড়াচ্ছি। দৌড়াতে দৌড়াতে আমরা তিন জন এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছি, যেখানে কাদা আর ঘন কাঁটাবন। আমাদের হাত-পা, পিঠ সব কাটায় ছিঁড়ে গেছে। রক্তাক্ত অবস্থা। সাথে সাথে আমরা সামনে কাদায় শুয়ে পড়লাম। তিন জনই পরস্পরকে শক্ত করে ধরে রাখি। যেন মনোবল এক থাকে। তখন আমি ভয় পেয়েছি বলব না, তবে ঘাবরে গেছি। দুটি স্বশস্ত্র গ্রুপের মাঝে নিরস্ত্র তিন জন মানুষ। আমরা যে জায়গাটায় ছিলাম সেটা ছিল আবার বাঘের আস্তানা। সেখানে একদিকে গুলির ভয়, আরেক দিকে বাঘের ভয়।
তখন এই সময়টা এমন ছিল যে বেঁচে আসব কি না তা আর ভাবতে পারছিলাম না। তবে বার বার মনে হচ্ছিল, আমরা তো খারাপ কাজ করতে আসিনি। ভালো নিয়তে এসেছি। সুতরাং আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়ে দিবেন। কিন্তু দেখেন, যদি সেদিন আমরা মারা যেতাম, প্রথমেই আমরা চিহ্নিত হতাম ডাকাত হিসেবে। তারপর ঢাকা থেকে আপনারা সাংবাদিকরা আমাদের পরিচয় তুলে ধরে বলতেন, আমরা কেন সেখানে গিয়েছি। নিশ্চয় আমাদের উদ্দেশ্য খারাপ ছিল।
এক সময় দস্যুদের সাথে কুলিয়ে উঠতে না পেরে কোস্টগার্ড এলোপাথাড়ি গুলি করতে করতে চলে যায়। সেদিন কাছ থেকে দেখলাম দস্যুরা চাইলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২/৪টা বোট ফেলে দিতে পারে। সেদিন দুই পক্ষের গুলি বিনিময়কালে মাস্টার বাহিনীর শুধু মাস্টার একাই অস্ত্র ওপেন করেছে। আর কেউ গুলি চালায়নি। তাও সব ফাঁকা গুলি করেছে। একটাও সরাসরি করেনি। সরাসরি করলে একজনও বেঁচে ফিরতে পারতো না।
দস্যুহিনীর সদস্যরাও স্বীকার করেছেন, তারা আসলে প্রশাসনের লোকজনকে সম্মান করে। তাই তাদের গায়ে গুলি করে না। নিজেদের আত্মরক্ষার্থে ফাঁকা গুলি চালিয়ে ভয় দেখায়। যেন তারা সরে যায় বা দস্যু বাহিনীকে চলে যাওয়ার সুযোগ দেয়।
তো সেখান থেকে যখন কোস্টগার্ড চলে গেল; আমরা কাটা, গাছ-পালা ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে এলাম। আমরা কোন দিকে কোথায় আছি বুঝতে পারছিলাম না।
মহসিন ভাইয়ের কিছু সিগন্যাল জানা আছে। যোগাযোগের জন্য কিছু সংকেত। ভাই একটা পাখির ডাক দিলেন। কয়েকবার দেয়ার পর অপরপ্রান্ত থেকে উত্তর এলো। যা স্বাভাবিকভাবে আপনি আমি শুনলে বুঝব না, মনে হবে পাখিই ডাকছে। কিন্তু যারা জানেন, তারাই বুঝবেন। পরে আমরা সেদিকে এগিয়ে গেলাম। আমাদের সামনে ঘন কাঁটাবন। আর বনের ওপাশে মাস্টার বাহিনীর সদস্যরা। আমি ভাইকে বললাম, আপনার নাম বলেন। ভাই বললেন, মাস্টার কই? আমি মহসিন।
ভাইয়ের কণ্ঠ শুনেই দস্যুবাহিনীর মাস্টার এগিয়ে এসে জাপটে ধরলেন। বললেন ভাই, আপনারা কই ছিলেন? আপনাদের খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে গেছি।
আসলে মাস্টার ও তার বাহিনীর মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। কারণ তাদের কাছে গেস্ট (মেহমান) আসছে। মহসিন ভাই হলেন তাদের কাছে পীরের মতো। তিনি দিনের পর দিন তাদের (দস্যু) সাথে বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি করেছেন।
তারপর আমাদের নিয়ে একটা বোট চলা শুরু করল। সবাই সতর্ক। বন্দুক তাক করা। বোট যিনি চালাচ্ছিলেন তিনি বুলেটপ্রুপ জ্যাকেট পরা। ২০ মিনিট বোট চলল। এই ২০ মিনিটে কোথা থেকে কোথায় চলে গেল সেটা কল্পনারও বাইরে। কারণ কোস্টগার্ড যে শক্তি বাড়িয়ে আবার আসবে না তার তো নিশ্চয়তা নেই। তাই আমাদের সেভ করতে তারা সেভজোনে চলে গেল।
আমরা সেখানে এসে দুপুরের খাওয়া দাওয়া করলাম। কিন্তু আমাদের জিনিসপত্র সব ওইখানেই রয়ে গেল। সেখান থেকে শুধু আমাদের নিয়ে একটা বোট বের হয়েছিল।
আমাদের রেখে মাস্টার একা একটা ছেলেকে নিয়ে দুপুর আড়াইটা থেকে ৩টার দিকে অস্ত্র ও গুলি নিয়ে সেখানে গেলেন। যাওয়ার সময় ৩টা বড় সাইজের খাল অস্ত্রগুলি নিয়ে সাঁতার কেটে পার হন। তারপর তিনি ওখানে গিয়ে জিনিসপত্র, মানুষজন সবাইকে কালেক্ট করেন। সবগুলোকে নিয়ে সব কয়টা বোটকে এক করে আমাদের যে খালে রেখে গেছেন সেখানে এসেছেন।
সেই রাতের জোয়ারে রাত ১টার দিকে আমরা বের হলাম। কিন্তু আমরা কোথায় আছি সেটা জানি না। আমাদের কাছে কোনো রোড ম্যাপও নেই।
চলবে…
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন