হাসপাতালের প্রধান ফটক থেকে কিছুটা ভেতরে মূল ভবন। ভেতরে ঢুকতেই ছোট ছোট কয়েকটি জটলা। প্রতিটি জটলাতেই একজনকে ঘিরে আছে দুই থেকে চারজন। জটলার কেন্দ্রে থাকা ব্যক্তি দুহাত নাড়িয়ে কী যেন বোঝাতে চাইছেন অন্যদের। গভীর মনোযোগ নিয়ে তা শুনছিলেন ক্লান্ত মানুষগুলো। চেহারায় ফুটে ওঠা অসহায়ত্ব দেখে মনে হচ্ছিল কাউন্সিলিং করছিলেন কোনো কাউন্সিলর।
পরে জানা গেল, আসলে তিনি একজন দালাল। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা রোগীর স্বজনদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়াই এই তার লক্ষ্য।
রাজধানী শেরে বাংলা নগরের জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের প্রতিদিনকার সাধারন চিত্র এটি। বিভিন্ন পরিচয়ে ছয়দিন হৃদরোগ হাসপাতালে ঘোরাঘুরির পর জানা গেছে তাদের কাজের পরিধি।
একটি অ্যাম্বুলেন্স এসে থামল হাসপাতাল ভবনের সামনে। সঙ্গে সঙ্গেই পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন এক যুবক। রোগীর স্বজনের সাথে কিছু একটা কথা হলো তার। এরপর একটি ট্রলি এনে তাতে রোগী ওঠালেন। রোগী ভর্তি থেকে শুরু করে যাবতীয় সব কাজই সারছেন ওই যুবক। এরই ফাঁকে অ্যাম্বুলেন্স চালকের কাছ থেকে তার ফোন নম্বর নিয়ে রাখলেন তিনি।
বাইরে থেকে জরুরি বিভাগে কোনো রোগী আসলে তাকে হাসপাতালে দায়িত্বে থাকা বয় ট্রলিতে করে গ্রহণ করবেন, এই নিয়মটাই যেন পাল্টে গেছে হৃদরোগ হাসপাতালে। ট্রলি সংগ্রহ থেকে বয়ে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সবকিছুই করতে হয় স্বজনদের। তবে টাকা দিলে ‘সেবা মেলে’ মুহূর্তেই।
শেরপুর থেকে এক আত্মীয়কে নিয়ে ঢাকায় এসেছেন মো. জসিম। ভর্তি করিয়েছেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে। হাসপাতালে ঢোকার পর থেকেই পিছু ধরে দালাল চক্র। এদের সম্পর্কে আগে থেকেই শুনেছেন জসিম। তাই তাদের ফাঁদে ধরা দেননি। নিজেই রোগীকে ভর্তি করিয়েছেন। কিন্তু বেড পাননি। জসিম জানান, দালাল ধরলে টাকার বিনিময়ে এখানে সবই সম্ভব। কিন্তু দালালকে যে পরিমাণ টাকা দিতে হয়, তা দিয়ে বেসরকারি হাসপাতালেই চিকিৎসা সম্ভব!
পরিচয় গোপন রেখে স্বজন ভর্তি করানোর বিষয়ে আল আমিন নামের এক দালালের সাথে কথা হয়। প্রথমেই তিনি রোগীর অবস্থা জানতে চান। অবস্থা সাধারণ হলে ভর্তি করানোর একদিনের মাধ্যে সিট পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন তিনি। আর অবস্থা গুরুতর হলে বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তিতে সহযোগিতা করবেন।
কথা হলো এক রোগীর স্বজন ইলিয়াস হোসেনে সঙ্গে, ‘হাসপাতালের প্রতিটি কাজের জন্যই দালালকে টাকা দিতে হয়। গোসল করতেও টাকা দিতে হয়। ১৫ টাকা দিলেই গোসলের সিরিয়াল পাওয়া যায়।’
এ ছাড়া বেড পাওয়া, হাসপাতাল থেকে ওষুধের ব্যবস্থা করা, রোগীর সাথে দেখা করাসহ সব বিষয়ই টাকার বিনিময়ে দালালরা সমাধান করে দেন বলে জানান ইলিয়াস, ‘দালাল ছাড়া কোনো কিছুই হয় না। কোনোভাবে সেটা হলেও ভোগান্তির শেষ নেই।’
কথা হয় আনোয়ার এক দালালের সাথে। বাড়ি ময়মনসিংহ। ২ বছর ধরে হৃদরোগ হাসপাতালে এই কাজ করছেন। সিট পাইয়ে দেওয়া, অন্য ক্লিনিকে ভর্তি করানোসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করেন তিনি। ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার বিনিময়ে রোগীদের সিটের ব্যবস্থা করেন বলে জানালেন। এ ছাড়া একজন রোগীকে অন্য হাসপাতালে পাঠাতে পারলে সেখান থেকে পান বড় অঙ্কের কমিশন।
মফস্বল শহর থেকে রোগী নিয়ে আসা সহজ-সরল স্বজনদের উন্নত সেবাসহ নানা সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে পাঠানোর কাজ করে একটি চক্র। কামরুজ্জামান নামের এক ব্যক্তি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে চাচাকে নিয়ে এসেছেন। তবে পাচ্ছেন না কাঙ্খিত সেবা। প্রতি পদে গুনতে হচ্ছে টাকা। এরই মধ্যে এক দালালের সাথে কথা হয় কামরুজ্জামানের। ভালো একটি হাসপাতালে রোগী ভর্তি করিয়ে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ওই দালাল। এখন কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না তিনি।
হৃদরোগের ক্ষেত্রে দেশের সবচেয়ে বড় বিশেষায়িত সরকারি এই হাসপাতালটিতে অভিযোগ করেও কোনো সমস্যার সমাধান পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রোগীর স্বজনদের। হাসপাতালের ভেতরের একটি চক্রের সঙ্গে এই দালালদের যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ তাদের। অন্য যেকোনো বেসরকারি হাসপাতালে রোগী পাঠাতে পারলে কমিশন পান দালালরা। আর তাই কমিশন পেতে হৃদরোগ হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠায় দালালদের এই চক্রটি। আর এ কারণেই হাসপাতালের আশেপাশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক। এসব হাসপাতলে রোগী যোগান দিয়ে মোটা অঙ্কের কমিশন নেওয়াই কাজ দালালদের এ চক্রের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক দালাল প্রিয়.কমকে জানান, হাসপাতালের ভেতরের লোকজনকে হাত করেই তারা এসব কাজ করেন। এতে রোগীদের ‘উপকার’ হয় বলে দাবি করেন তিনি। বিনিময়ে স্বজনদের কাছ থেকে ‘অল্প কিছু পারিশ্রমিক’ নেন তারা।
ছয়দিনের প্রায় প্রতিদিনই হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ফটকে পাওয়া যায় মো. আলমকে। রোগীদের সার্বক্ষণিক ‘সেবা’য় নিয়োজিত তিনি। ‘পরামর্শ’ দিয়ে থাকেন রোগীর স্বজনদের। বছর তিনেক ধরে হাসপাতালে আসা-যাওয়া তার। রোগীদের বিভিন্ন ‘সেবা’ দিয়ে উপার্জিত অর্থ দিয়েই সংসার চলে আলমের।
হাসপাতালে সেবা পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল হলো জেলখানার মতো। টাকা দিবেন সব সেবা পাবেন। সিট থেকে শুরু করে সব কিছু।’ এসবের জন্য কোনো ঝামেলায় পড়তে হয় কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা হাসপাতালের কয়েকজনকে বিভিন্ন উপায়ে হাতে রাখি। এজন্য তেমন কোনো অসুবিধা হয় না। তবে যখন কোনো অভিযান চলে তখন কয়েকদিন এদিকে আসি না।’
হৃদরোগ হাসপাতালের ভেতর ঘুরে দেখা যায়, বারান্দার মেঝেতেও পা রাখার জায়গা নেই। সারি সারি বিছানা পেতে শুয়ে আছেন রোগীরা। কোনোভাবে ডাক্তার দেখাতে পারলেও প্রত্যাশিত চিকিৎসা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রোগী ও তাদের স্বজনদের।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আফজালুর রহমান প্রিয়.কমকে বলেন, ‘হাসপাতালে দালালদের দৌরাত্ম্য কমাতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রায়ই মাইকিং করা হয়ে থাকে। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো মানুষের সচেতনতা। মানুষকে সচেতন করতে আমরা প্রায়ই বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে থাকি।’
রোগীর স্বজনদের অতিরিক্ত চাপের মধ্যে দালালরা সুযোগ গ্রহণ করে বলে জানান তিনি।
হাসপাতালের অবকাঠামোসহ সেবার মান আরও বাড়ানোর জন্য নতুন নতুন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলেও দাবি করেন অধ্যাপক ডা. আফজালুর রহামান।
তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (হাসপাতাল) মো. হাবিবুর রহমান প্রিয়.কমকে বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে দালালের দৌরত্ম্য আছে এটা ঠিক। তবে এদের ঠেকাতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আর হৃদরোগ হাসপাতালে রোগীর চাপ সব সময় বেশি থাকে, তাই এ সুযোগ কাজে লাগায় দালালরা।’
দালালদের ফাঁদে পা দেওয়ার জন্য রোগীর স্বজনদের দায়ী করেন মো. হাবিবুর রহমান। তবে নিয়মিত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আগের থেকে দালালের প্রকট অনেক কমেছে বলে দাবি করেন তিনি। এ ছাড়া হৃদরোগীর চাপ সামলাতে জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের ভবন আরও দুই তলা বর্ধিত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ কাজ আগামী দুই বছরের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন হাবিবুর রহমান।
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন