‘যিনি আমার চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন, যার নির্দেশে চিকিৎসকরা আন্তরিকভাবে আমাকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলছেন, সেই প্রধানমন্ত্রীকে আমি একটু দেখতে চাই’।
‘চিকিৎসকরা আমাকে জানিয়েছেন, তিনি (প্রধানমন্ত্রী) প্রায় সময়ই আমার চিকিৎসার খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। সেই প্রধানমন্ত্রীকে আমি একটু দেখতে চাই। আঙ্কেল, আমাকে একটু প্রধানমন্ত্রী দেখাবেন?’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেখতে চেয়ে কথাগুলো বলছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে বার্ন ইউনিটের কেবিনে চিকিৎসাধীন রক্তনালীতে টিউমারে (হেমানজিওমা) আক্তান্ত শিশু মুক্তামনি।
আক্রান্ত ডান হাতটি না কেটেই চার দফা সফল অস্ত্রোপচারের পর চিকিৎসকরা আশা করছেন, আগামী ২ থেকে ৩ সপ্তাহের মধ্যে মুক্তামনিকে বাড়িতে যাওয়ার ছাড়পত্র দেওয়া হতে পারে।
তারা জানান, টিউমার অপসারণের পর মুক্তামনির পা থেকে চামড়া নিয়ে ডান হাতে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। প্রথম ধাপে প্রায় ৫০ শতাংশ চামড়া প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
সর্বশেষ গত ০৮ অক্টোবর চতুর্থ দফার অস্ত্রোপচারে হাতটিকে নতুন চামড়া লাগানোর উপযোগী করা হয়েছে। এটি তার সুস্থ হওয়ার প্রথম ধাপ বলে সেদিন জানিয়েছিলেন চিকিৎসকরা।
বৃহস্পতিবার (২৩ নভেম্বর) সন্ধ্যায় মুক্তামনি বাংলানিউজকে বলে, ‘আমি এখন আগের চেয়ে ভালো আছি। তবে ডান হাত ফুলে গেছে। আমার কাছে হাতটি আগের মতোই লাগে। হাতে-পায়ে প্রচণ্ড চুলকায়। তবে চিকিৎসকরা বলেছেন, আস্তে আস্তে ফোলা কমে যাবে’।
‘আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে চাই’- ফের বলে মুক্তামনি।
ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ও মুক্তামনির চিকিৎসায় গঠিত ১৩ সদস্যের মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘মুক্তামনি এখন ভালো আছে। ওর পা থেকে চামড়া সংগ্রহ করে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হাতে লাগানো হয়েছিল, সেটি ঠিকমতো লেগেছে’।
‘তবে তার হাত একটু ফুলে গেছে। সেটির জন্যও চিকিৎসার কিছু পদ্ধতি আছে, সেগুলো দেওয়া হচ্ছে। আশা করছি, ফোলা কমে যাবে’।
তিনি বলেন, ‘১০ বছর ধরে মুক্তামনি রক্তনালীতে টিউমার রোগে আক্রান্ত হয়ে হয়ে ভুগছে। রোগ সারতে একটু সময়তো লাগবেই’।
সাতক্ষীরা সদর
উপজেলার দক্ষিণ কামারবায়সা গ্রামের ইব্রাহিম হোসেন ও আসমা খাতুন দম্পতির মেয়ে মুক্তামনির ডান হাতে প্রথমে টিউমারের মতো হয়। ছয় বছর বয়স পর্যন্ত টিউমারটি তেমন বড় হয়নি। কিন্তু পরে তার হাতটি ফুলে অনেকটা কোলবালিশের মতো হয়ে যায়! এক পর্যায়ে হাতে পচন ধরে। সাদা রঙের শত শত পোকা ঘুরে বেড়াতে থাকে সেই ফুলে যাওয়া অংশে। শরীরের অসহ্য ব্যথা ও যন্ত্রণায় বসতেও পারতো না। হাতের সঙ্গে বুকের একাংশেও ছড়িয়ে পড়ে রোগটি। দীর্ঘ নয় বছরেও মুক্তার রোগ ধরতে পারেননি চিকিৎসকরা।
এরপর সংবাদমাধ্যমে তাকে নিয়ে নিউজ হলে গত ১১ জুলাই মুক্তামনিকে ভর্তি করা হয় ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। তার চিকিৎসার দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গত ২৭ জুলাই ভিডিও কনফারেন্সে মুক্তামনিকে ও তার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রতিবেদন দেখেন এবং ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকদের সঙ্গে বোর্ড মিটিং করেন সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকরা।
পরে ই-মেইলে সিঙ্গাপুরের হাসপাতালটি জানিয়েছিলো, ‘রোগটি ভালো হওয়ার নয় ও সেটি অস্ত্রোপচার করার মতোও নয়’।
এ পর্যবেক্ষণ জানার পর গত ০২ আগস্ট ঝুঁকিপূর্ণ হলেও সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করে বায়োপসি করার সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকরা। সে অনুসারে গত ০৫ আগস্ট সফলভাবে মুক্তামনির বায়োপসি অপারেশন সম্পন্ন হয়।
বায়োপসি রিপোর্টে চিকিৎসকরা জানতে পারেন, রক্তনালীতে টিউমার বা ‘হেমানজিওমা’ রোগে আক্রান্ত শিশুটি। পরে ডান হাতটি কেটে ফেলার ঝুঁকি থাকলেও সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত
নেন মেডিকেল বোর্ড।
গত ১২ আগস্ট প্রথম দফায় মুক্তামনির ডান হাত অক্ষত রেখেই দু’ঘণ্টার সফল অস্ত্রোপচার করা হয়। ডা. সামন্ত তখন জানিয়েছিলেন, তিন কেজির মতো বাড়তি মাংস অপসারণ করা হয়েছে। টিউমার অপসারণে ফের কয়েকদফা অস্ত্রোপচার করতে হবে।
এরপর গত ২৯ আগস্ট দ্বিতীয় দফার অস্ত্রোপচার শুরু হলেও জ্বর আসায় তা বন্ধ রাখা হয়। গত ০৫ সেপ্টেম্বর তৃতীয় দফার অস্ত্রোপচারও সফল হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন