বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যে ব্যাংকটির ঋণ কেলেঙ্কারি নিয়ে আরেকটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
হাই কোর্টের উষ্মা প্রকাশের পরও আগের ৫৬টি মামলার মতো এই মামলাতেও বাচ্চু বা পরিচালনা পর্ষদের কাউকে আসামি করা হয়নি।
বুধবার ঢাকার বংশাল থানায় দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল হক বাদী হয়ে মামলাটি করেন।
এতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির বরখাস্ত এক ডিএমডিসহ তিনজনকে আসামি করা হয় বলে কমিশনের উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) প্রনব কুমার ভট্টাচার্য্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।
আসামিরা হলেন- বেসিক ব্যাংকের বরখাস্ত ডিএমডি ও বাবুবাজার শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক মো. সেলিম, ইকসল ফুড অ্যান্ড বেভারেজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম।
এর আগে বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় দুদক যে ৫৬টি মামলা করেছে, সেলিম তার ৪০টিরই আসামি বলে সিরাজুল হক জানিয়েছেন।
নতুন মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে ৭ কোটি ৮৫ লাখ ৩২ হাজার ৯৮৮ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।
২০১০ সালের ২৯ মার্চ থেকে ২০১৬ সালে ১৩ অক্টোবর সময়ে এই অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটে বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়।
বাদী সিরাজুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় বলেন, “বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চু পর্ষদের সময়ে ওই ঋণ মঞ্জুর করা হয়।”
বাচ্চু ও তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের কাউকে আসামি না করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “মামলার তদন্তে যদি পরিচালনা পর্ষদের কারও নাম আসে তাহলে তাকে বা তাদেরকেও আসামি করা হবে।”
মামলায় অভিযোগ বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে আগে বিক্রি করা জমি বন্ধক দেখিয়ে ও অতিরিক্ত মূল্য ধরে এবং প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্র গ্রহণ না করে ও যথাযথ যাচাই না করে ঋণ মঞ্জুরের শর্ত ভঙ্গ করে বেসিক ব্যাংক বাবু বাজার শাখা থেকে ৫ কোটি ৭৯ লাখ ৮১৬ টাকা ঋণ দেওয়া হয় মেসার্স ইসকল ফুড অ্যান্ড বেভারেজকে। ওই ঋণ সুদ আসলে ৭ কোটি ৮৫ লাখ ৩২ হাজার ৯৮৮ টাকা দাঁড়িয়েছে, যা আসামিরা আত্মসাৎ করেছেন।
ফাইল ছবি ফাইল ছবি
২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে বেসিক ব্যাংকের গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখা থেকে মোট সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণের অভিযোগ ওঠার পর তদন্তে নামে দুদক।
ঋণপত্র যাচাই না করে জামানত ছাড়া, জাল দলিলে ভুয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দানসহ নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে বিধি বহির্ভূতভাবে ঋণ অনুমোদনের অভিযোগ ওঠে ব্যাংকটির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে।
প্রায় চার বছর অনুসন্ধান শেষে এই অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনায় গত বছর রাজাধানীর তিনটি থানায় ১৫৬ জনকে আসামি করে ৫৬টি মামলা করে দুদক। আসামিদের মধ্যে ২৬ জন ব্যাংক কর্মকর্তা এবং বাকিরা ঋণ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক জরিপ প্রতিষ্ঠানে যুক্ত।
আসামির তালিকায় বাচ্চু বা ব্যাংকটির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের কেউ না থাকায় দুদকের ওই তদন্ত নিয়েই প্রশ্ন ওঠে।
গত অগাস্টে এক মামলার শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের মামলায় বাচ্চু ও পরিচালনা পর্ষদকে আসামি না করায় উষ্মা প্রকাশ করে।
ব্যক্তি যেই হোক না কেন- এ ধরনের মামলায় আসামি করার ক্ষেত্রে ‘পিক অ্যান্ড চুজ’ যেন না হয় সে বিষয়ে দুদককে সতর্কও করে আদালত।
এই প্রেক্ষাপটে বাচ্চুকে তলব করে দুদক; গত দুই দিন ধরে তিনি দুদকে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হচ্ছেন।
জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য বাচ্চুকে ২০০৯ সালে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দিয়েছিল সরকার। ২০১২ সালে তার নিয়োগ নবায়নও হয়। কিন্তু ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠলে ২০১৪ সালে চাপের মুখে থাকা বাচ্চু পদত্যাগ করেন।
৩ জনের জামিন
আগের মামলায় বেসিক ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ফজলুস সোবহানসহ তিনজনকে শর্তসাপেক্ষে জামিন দিয়েছে হাই কোর্ট।
জামিনপ্রাপ্ত অন্য দুজন হলেন, বেসিক ব্যাংকের ইন্টারনাল ক্রেডিট ডিভিশনের জিএম মো. সেলিম, ও ব্যাংকটির গুলশান শাখার ব্যবস্থাপক শিপার আহমেদ।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের হাই কোর্ট বেঞ্চ বুধবার এই তিনজনের জামিন মঞ্জুর করে।
দুদকের আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব সাংবাদিকদের বলেন, “চার মামলায় ফজলুস সোবহানকে এবং দুটি করে মামলায় অন্য দুজনের জামিন হয়েছে।”
জামিনের শর্তের মধ্যে রয়েছে, আদালতের কাছে পাসপোর্ট জমা রাখতে হবে এবং আদালতের অনুমতি ছাড়া বিদেশে যেতে পারবেন না।
দুদকের অন্য আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, “এসব মামলায় জামিন পেলেও অন্য মামলায় তাদের জেলেই থাকতে হবে। তাছাড়া এই তিনজনের জামিনের বিষয়ে হাই কোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করবে দুদক।”
এদিকে জামিন আবেদনের শুনানিতে আদালত আইনজীবীদের উদ্দেশে বলে, আবদুল হাই বাচ্চু নিজেই বলেছেন যে বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির পেছনে একটি ‘সিন্ডিকেট জড়িত’।
“ব্যাংক লুটপাটের বিষয়গুলো শক্তভাবে দেখা দরকার। আর্থিক অপরাধের যেকোনো বিষয় নিষ্ঠার সঙ্গে দেখা উচিত। তা না হলে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে, ধ্বংস হয়ে যাবে।”
আদালত এসময় দুদকের তদন্ত কার্যক্রম এবং অভিযোগপত্র দিতে দেরি হওয়ায়ও উষ্মা প্রকাশ করে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন