সরকারের দুঃসময়ে চুক্তিভঙ্গকারী মালিকদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করবে না খাদ্য অধিদপ্তর। চলতি আমন মৌসুম ছাড়াও আগামী তিন মৌসুমে এ সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে। সরকারের এ কালো তালিকায় রয়েছেন সারাদেশের অন্তত ১৫ হাজার মিল মালিক। পাশাপাশি সরকারের দুঃসময়ে চাল সরবরাহকারী ব্যবসায়ীদের দেওয়া হয়েছে বিশেষ প্রণোদনা। তাদের উৎসাহিত করতে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
এদিকে সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন সংশ্নিষ্টরা। তারা বলছেন, মিলারদের কাছ থেকে চাল না কেনার মতো এমন কঠোর সিদ্ধান্ত এবারই প্রথম। এ ধরনের সিদ্ধান্তের কারণে ভবিষ্যতে ব্যবসায়ীদের সরকারকে কোনো কাজে বাধ্য করার প্রবণতা বন্ধ হবে। পাশাপাশি দেশে খাদ্যশস্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করাও সরকারের পক্ষে সহজ হবে। তবে সরকারের এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করে না অটো রাইস মিল মালিক সমিতি। তাদের অভিযোগ, খাদ্য অধিদপ্তরের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে চলতি মৌসুমে চালকল মালিকদের একটি সিন্ডিকেট এতে লাভবান হবে।
সংশ্নিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, চলতি আমন মৌসুমে সরকার তিন লাখ টন সিদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। চালের সংগ্রহমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৯ টাকা। আগামী ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত চালকল মালিকদের সঙ্গে এ চুক্তি রয়েছে। তবে সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে এ সময়সীমা বাড়ানো হতে পারে।
এ বিষয়ে খাদ্য অধিদপ্তরের সংগ্রহ বিভাগের পরিচালক মো. আবদুল আজিজ মোল্লা জানান, গত বোরো মৌসুমে মিলারদের সরবরাহ করা চালের আনুপাতিক হারে চালের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কোনো মিলার চুক্তির চাল কোনো কারণে ১৫ দিনের মধ্যে সরবরাহে ব্যর্থ হলে পরিস্থিতি বিবেচনা করে সর্বোচ্চ ৩০ দিন বাড়তি সময় পাবেন। এ সময়ের মধ্যে মিলার চাল দিতে না পারলে চুক্তি বাতিল হবে।
খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ মৌসুমে ৩ লাখ টন আমন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। রংপুর বিভাগ ছাড়া বাকি সব বিভাগের চালকল মালিকরাই রয়েছেন কালো তালিকায়। এ বিভাগের ৫৮ উপজেলা থেকে ১ লাখ ২১ হাজার ৪৩৮ টন চাল সংগ্রহ করবে সরকার। ঢাকা বিভাগের ১২৪ উপজেলার মধ্যে ৭২ উপজেলার মিলারদের কাছ থেকে ৬২ হাজার ১৩৫ টন চাল সংগ্রহ করা হবে। বাকি ৫২ উপজেলার মিলার কালো তালিকাভুক্ত। তাদের কাছ থেকে আগামী আরও তিন মৌসুম চাল সংগ্রহ করবে না সরকার। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগের ১০২ উপজেলার মধ্যে ৭৯ উপজেলাই কালো তালিকাভুক্ত। বাকি ২৩ উপজেলার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাত্র ৬ হাজার ৩১৪ টন চাল সংগ্রহ করা হবে। রাজশাহী বিভাগের ৫৭ উপজেলার মিলারদের কাছ থেকে ৭৬ হাজার ৫৩৬ টন চাল কেনা হবে। কালো তালিকায় রয়েছেন ১০ উপজেলার চালকল মালিকরা। খুলনা বিভাগের ৫৩ উপজেলার ৪৬টি উপজেলা থেকে ৩০ হাজার ৯৭১ টন চাল সংগ্রহ করা হবে। বাকি ৭ উপজেলা কালো তালিকায়। বরিশাল বিভাগের ৪২ উপজেলার মধ্যে ২৯ উপজেলার চালকল মালিকরাই কালো তালিকায়। বাকি ১৩ উপজেলার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাত্র ১ এক হাজার ৩৮৩ টন চাল সংগ্রহ করা হবে। একই অবস্থা সিলেট বিভাগের। এ বিভাগের ৩৯ উপজেলার মধ্যে কালো তালিকায় ৩৩ উপজেলার ব্যবসায়ীরা। বাকি ৬ উপজেলার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ১ হাজার ২২৩ টন চাল সংগ্রহ করা হবে।
আগের বছর ২০১৬-১৭ মৌসুমে আমন সংগ্রহে সরকার দুই লাখ ৫০ হাজার টন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল, তার মধ্যে ৮৯ ভাগ পূরণ হয়েছে। আর ২০১৬ সালে বোরো সংগ্রহে সরকারের লক্ষ্যমাত্রার পূরণ হয়েছিল ৮৮ ভাগ।
খাদ্য অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সারাদেশের ২২ হাজার ৪৬৩ চালকল মালিক সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে চাল সরবরাহ করে আসছেন। গত বোরো মৌসুমে তাদের একটি অংশ চুক্তিবদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েও শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে যায়। তারা সরকারের ওপর চালের দাম বাড়ানোর চাপ প্রয়োগ করে। সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও তা মানতে অস্বীকার করেন মিলাররা। বোরো মৌসুমে প্রতি কেজি চাল ৩৪ টাকা করে সংগ্রহ করার ঘোষণা ছিল সরকারের। কিন্তু চালকল মালিকরা তাতে সাড়া দেননি। চালকলের মালিকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ অটো, মেজর, হাসকিং ও মিল মালিক সমিতি খাদ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে প্রতিকেজি চালে আরও ৪ টাকা বেশি দাবি করে।
তাদের অসহযোগিতার কারণে গত বোরো মৌসুমে চাল সংগ্রহের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও পূরণ করতে পারেনি সরকার। ওই সময় খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম মিলারদের বারবার সতর্ক করে সরকারকে চাল সরবরাহ করার নির্দেশ দেন। সে সময় তিনি বলেছিলেন, দুঃসময়ে যারা পাশে থাকে না সরকার তাদের ক্ষেত্রে অনুকম্পা দেখাবে না। তবে যারা এবার চুক্তি করবে না তাদের আগামী ৩ বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করা হবে। আর যারা সরকারের পাশে থাকবে তাদের জন্য আগামীতে বরাদ্দের পরিমাণ দ্বিগুণ করা হবে।
মন্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়া এমন নির্দেশের পরও নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন চালকল মালিকরা। তারা বিষয়টিকে সাধারণ ঘটনা হিসেবেই ধরে নেন। অর্ধেকেরও বেশি চালকল মালিক চুক্তিভঙ্গ করে সরকারকে চাল সরবরাহ থেকে বিরত থাকেন। গত মৌসুমে ৭ লাখ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও সংগ্রহ হয় অর্ধেকের চেয়ে কম মাত্র ৩ লাখ ৩৪ হাজার ৪৬৯ টন। তবে চালকল মালিকরা বলছেন, বোরো মৌসুমে বন্যা, পাহাড়ি ঢলসহ নানান কারণে ধান উৎপাদন ব্যাহত হয়। পরে চালের দামও বেড়ে যায়। মূলত এসব কারণেই তারা সরকারের সঙ্গে চুক্তি করা মূল্যে চাল সরবরাহ করতে পারেননি।
খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, খাদ্য বিভাগের ইতিহাসে একইসঙ্গে এত সংখ্যক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নজির এটাই প্রথম। পাশাপাশি একযোগে এত সংখ্যক ব্যবসায়ীর অসহযোগিতার নজিরও এবারই প্রথম বলে মন্তব্য করেন তারা।
এদিকে খাদ্য অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে চলতি মৌসুমে চালকল মালিকদের একটি সিন্ডিকেটকে লাভবান করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন অটো রাইসমিল মালিক সমিতির সভাপতি খোরশেদ আলম খান। তিনি বলেন, গত বোরো মৌসুমে যারা সংকট সৃষ্টি করে চালের দাম বাড়িয়েছিল তারাই আবার সরকারকে চাল দিয়েছিল। আমন মৌসুমে এসে সেই তারাই আবার সুবিধা ভোগ করছে। দুঃসময়ে যারা পাশে ছিল তাদের পাশে রয়েছে সরকার। একে একটি মহলের কারসাজি দাবি করেন খোরশেদ আলম। তিনি বলেন, সরকার যে কোনো সময়ে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে এসব সিদ্ধান্ত কতটুকু যৌক্তিক তাও দেখতে হবে। বোরো মৌসুমে সরকার যখন চাল কেনার সিদ্ধান্ত নেয় তখন মাঠে আর কোনো ধান ছিল না। বড় চালকল মালিকরা সব ধান নিজেরা নিয়ে নেয়। সে সময় ছোট চালকল মালিকদের পক্ষে চাইলেও সরকারকে চাল সরবরাহ অসম্ভব ছিল। ওই সুযোগটাই নিয়েছিল চালকল মালিকদের একটি সিন্ডিকেট।
বর্তমানে ৩৯ টাকা দরে আমন সংগ্রহ করে সরকার ভুল করছে দাবি করে অটো রাইসমিল মালিক সমিতির সভাপতি বলেন, এখন দেশের বাজারে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এ পরিস্থিতিতে সরকার চাল কেনা শুরু করলে আবার চালের সংকট দেখা দিতে পারে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আরও কম টাকায় চাল আমদানি করা সহজ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সমকালের কুষ্টিয়া প্রতিনিধি সাজ্জাদ রানা জানান, আমন মৌসুমে কুষ্টিয়া জেলায় চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১১ হাজার ৮৫৪ টন। এর মধ্যে সদর থেকে কেনা হবে ৮ হাজার ৯২৬ টন। গত বোরো মৌসুমে নানা সংকট মোকাবেলা করেও কুষ্টিয়া জেলা খাদ্য অফিসকে ১০ হাজার টন চাল সরবরাহ করেন ১৯৩ জন চালকল মালিক। তাই এ বছর কুষ্টিয়া জেলায় বরাদ্দ দ্বিগুণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ৩৯ টাকা দর দেওয়ায় সরকারকে সাধুবাদ জানিয়েছেন মিল মালিক সমিতির নেতারা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত মিল মালিকরা কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন বলে তারা মন্তব্য করেন।
কুষ্টিয়া জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নুল আবেদিন প্রধান বলেন, সরকারের এ সিদ্ধান্তে মিল মালিকরা খুশি।
কুষ্টিয়া সদরের লিয়াকত হোসেন রাইসমিলের মালিক হাজি লিয়াকত হোসেন জানান, গত বোরো মৌসুমে কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা লোকসান দিয়ে তিনি সরকারকে চাল সরবরাহ করেন। এ বছর চালের দর ৩৯ টাকা দেওয়ায় ক্ষতি পোষাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন