রাজধানীর একটি শিশু হাসপাতালে কাজ করতেন ময়না (ছদ্মনাম)। চেনা এক লোক জানালো বিদেশ গেলে মাসে ত্রিশ হাজার টাকা বেতন। সৌদি মুসলমানদের দেশ জেনে সেও রাজি হয়ে যায়। এক লাখ টাকা খরচ করে যখন সৌদি আরব পৌঁছান ময়না, সেখানে তাকে রিসিভ করে দু’জন। রাতের বেলা ময়না বুঝতে পারেন, তিনি কোনও কাজে আসেননি, তাকে যৌনকর্মী হিসেবে বিক্রি করা হয়েছে।
গণশুনানিময়না বলেন, ‘তারা আমাকে পাতলা জামা দিসে, পরি নাই। প্রতি রাতে আমাকে অত্যাচার করতো। বাড়ির সব পুরুষ, কেউ বাদ নাই। এরপর তারা আমাকে দুবাই বিক্রি করল। সেখানে একটা অফিসের মধ্যে রাখে। আমি ওই কাজ করতে চাই না বলে মারে, আমার শরীরের মাংস কামড়াইয়া ছিঁড়ে ফেলে। কোনওমতে সুযোগ করে বাংলাদেশে কল করে বলি, আমারে নিয়ে যাও। আমি আর পারি না।’ ময়না সেখানে ১১ মাস ছিল।
একইরকমভাবে শারিরীক-মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে জর্ডান থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন ইয়াসমিন (ছদ্মনাম)। ইয়াসমিন বলেন, ‘দেশে থাকতে বাসাবাড়ি কাজ করতাম। এসময় এক দালালের সঙ্গে পরিচয় হয়। আমাকে বলেছিল জর্ডানে নিয়ে গার্মেন্টসে কাজ দিবে। ৪০ হাজার টাকা নিসে। গেলাম জর্ডানে। সেখানে গিয়ে কী বিপদ। ভাষা জানিনা, কিছু চিনি না। গার্মেন্টস দূরে থাক, বাসাবাড়ির কাজ করতে শুরু করলাম। পরে বুঝলাম আমাকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাড়ির পুরুষেরা অত্যাচার করত, বাড়ির ম্যাডামকে বললে তিনি রাগ করতেন। প্রতি রাতে-দিনে একাধিক পুরুষ যৌন অত্যাচার করত। ওই পরিবার ইন্দোনেশিয়ান ছিল, তারা আমাকে একসময় ভাগায়ে দিলো। রাস্তায় পুলিশ গাড়িতে উঠিয়ে তিন মাস রেখেছে জেলে। এরপর অন্যদের সহায়তায় বাংলাদেশে কল দিয়েছি। সরকার যদি আমাদের দিকে তাকাইত, দালাল আলতাফকে শাস্তি দিত। দালালকে আমি চিনি, তারপরও শাস্তি দিতে পারিনি।’
গণশুনানিতে অংশ নেওয়া নারীরানির্যাতনের কারণে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশ মধ্যপ্রাচ্যে নারী গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিলেও বাংলাদেশ দুই-তিন বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে বিপুলসংখ্যক গৃহকর্মী পাঠাচ্ছে। এর মধ্যে সৌদি আরবে ২০১৬ থেকে নারীকর্মীরা যাচ্ছেন। আর সেখানেই সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের অভিযোগ। গার্মেন্টেসে চাকরি দেওয়ার নাম করে নিয়ে যৌনদাসী বানানো, এই কাজ না করতে চাইলে ঘরে আটকে রেখে মারধর, একবেলা খেতে দেওয়া, কারও সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করতে না দেওয়া থেকে শুরু করে হেন কোনও নির্যাতন নেই যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে না এই নারীদের।
কোনওমতে প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরলেও ফিরে আসা নারী শ্রমিকরা বলছেন, ‘আমরা ধার করে বিদেশ গেছি আয় করে ধার শোধের আশায়। ফিরতেও লেগেছে লাখ খানেক টাকা। এখন আমরা নিঃস্ব।’
অভিবাসী শ্রমিক নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা বলছেন, ‘২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আরবে গৃহকর্মী পাঠানোর যে চুক্তি হয়েছিল, তাতে নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তবে সেটি হচ্ছে না। যথাযথ ভাষা শিক্ষা ও কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে গার্মেন্টেসের কাজ নিশ্চিত করে তবেই পাঠাতে হবে নারী শ্রমিকদের, গৃহকর্মী হিসেবে কোনওভাবেই নয়।’
সম্প্রতি ‘ওয়ান বিলিয়ন রাইজিং’ নারী গৃহশ্রমিকদের নির্যাতনের গণশুনানির ব্যবস্থা করে। সেখানে আসা নির্যাতনের শিকার নারীরা সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, লেবানন, কাতার থেকে ফেরা। তারা প্রত্যেকে বলেন, ‘গৃহকর্মী হিসেবে যাওয়া নারীরা শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এক বছরে আড়াই’শরও বেশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া সিরিয়ায় অবৈধভাবে পাচার হওয়া বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি নারী যৌন নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাদের কেউ কেউ পরিবারের উদ্যোগে দেশে ফিরতে পেরেছেন। এ নিয়ে তাদের পরিবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেছে।’
সৌদি আরবে কাজ করতে গিয়ে নারীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার প্রমাণ থাকলেও প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বলছে, ‘আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।’
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আরবে নারী কর্মী পাঠানোর চুক্তি হয়। সে বছর ২০ হাজার ৯৫২ জন নারী দেশটিতে গিয়েছেন। আর এ বছরের প্রথম তিন মাসেই গেছেন ২০ হাজার ৩৬ জন। এছাড়া গত তিন বছরে ৬০ হাজার নারীকর্মী জর্ডানে, ৫০ হাজার নারী আরব আমিরাতে, ৪০ হাজার নারী লেবানন, ৩০ হাজার নারী ওমান ও ১৭ হাজার নারী কাতারে গেছেন।
ফিরে আসা নারী শ্রমিকরা বলছেন, ‘কেউ কেউ এখনও আছেন নির্যাতনের শিকার হয়ে আটক আছেন জেলে বা এজেন্সির লোকদের কাছে। কিন্তু যোগাযোগ করতে না পারায় ফিরে আসতে পারছেন না।’
বাংলাদেশি অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের (বমসা) পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া গৃহকর্মীদের নির্যাতনের খবর আমরা রোজই পাচ্ছি। তবু নারীরাও আগ্রহ নিয়ে যেতে চায় কারণ তারা ওখানে কী হতে পারে তারা তা জানেন না এবং দেশে তাদের ওপর যে নির্যাতন ঘটে সেটা থেকে সাময়িক মুক্তি চান।’
অভিযোগের বিষয়ে কিছুই জানেন না উল্লেখ করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (কর্মসংস্থান-৫, গবেষণা) সৈয়দা সাহানা বারী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের কাছে এ ধরনের সুনির্দিষ্ট কোনও অভিযোগ নেই। যদি কেউ অভিযোগ করে সে ক্ষেত্রে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি।’
বেসরকারি পর্যায়ে বিদেশে নারীদের কর্মসংস্থান সমস্যার বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘ডকুমেন্টারি নিয়োজিত করা উচিত। যারা শ্রমিক নেবেন, তাদেরও পছন্দ-অপছন্দ থাকে। সেদিক বিবেচনা করা উচিত।’
অভিযোগ থাকলেও তারা স্বীকার করবেন না উল্লেখ করে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সবসময়ই বলে আসা হচ্ছে নির্যাতনের মাত্রা কম। সেটি যদি মেনেও নিই, নির্যাতন ঘটছে জানার পরও কেন প্রটেকশনের ব্যবস্থা না নিয়েই মেয়েদের পাঠাচ্ছি।’
লিখিত অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে কর্তৃপক্ষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ‘উনাদের কাছে হাজার হাজার লিখিত অভিযোগ আছে। ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা কেন গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করেছে সেটা আগে দেখা উচিত। কর্তৃপক্ষ বলার চেষ্টা করে অভিযোগ ২ থেকে ৩ শতাংশ। মোট পাঠানো নারী শ্রমিকের মধ্যে ২/৩ হাজার মেয়ে নির্যাতনের শিকার হলে সেটি কম হয় কী করে। গৃহকর্মী হিসেবে মেয়ে পাঠানোর বিষয়ে ভাবার সময় এসেছে। পাঠাতেই যদি হয়, তাহলে প্রশিক্ষণ ছাড়াও প্রত্যেকের হাতে মোবাইল ফোন দিতেই হবে। তাকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার কোনও অধিকার আমাদের নেই। অভিযোগ কম না বেশি সেই সংখ্যা দিয়ে নির্যাতনের মাত্রা নির্ধারণ সম্ভব না।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন