নিহত ছাত্রলীগ নেতা শাবাব আর মাহির বাড়িতে এখনো চলছে শোকের মাতম। পাড়া প্রতিবেশীরা দু’পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে ভিড় জমাচ্ছেন। ছেলে হারানোর শোকে মা বাবা ও স্বজনরা বিলাপ করছেন আর মূর্ছা যাচ্ছেন। উপস্থিত সবার কাছে ছেলেকে ফিরিয়ে দেয়ার আকুতি জানাচ্ছেন তারা। তাদের এমন আর্তনাদ আর বোবা কান্নায় ভারি হয়ে উঠছে পরিবেশ। এই খুনের ঘটনায় উদ্বিগ্ন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও নানা শ্রেণি পেশার মানুষ। চলছে নানা আলোচনা সমালোচনা। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে এ জেলায় এই প্রথম জোড়া খুনের ঘটনায় জেলার সর্বমহলের বাসিন্দাদের মধ্যে বাড়ছে নানা উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী নিয়ে নতুন করে ভাবনায় পড়েছেন অভিভাবক মহল। এ ঘটনার পর থেকে শহরের স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীরাও আতঙ্কিত। এ যেন শান্তির শহরে হঠাৎ অশান্তির বিষাক্ত ছোঁবল। গতকাল নিহত শাবাব ও মাহির বাড়িতে গেলে এমন দৃশ্যই চোখে পড়ে। গতকাল সকালে মৌলভীবাজার শহরের পুরাতন হাসপাতালের সিদ্দিক মঞ্জিলের বাসায় নিহত ছাত্রলীগ নেতা শাবাবের মা সেলিনা রহমান চৌধুরী, বাবা অবসর প্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিক ছেলের নানা স্মৃতি তুলে ধরে অঝোরে কাঁদছিলেন। বাসায় শাবাবের দুই খালা ও অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বোন ফাতেমা সাফওয়াতসহ স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীরা তাদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন। শাবাবের মা সেলিনা রহমান চৌধুরী কেঁদে কেঁদে জানালেন যাদের আমার ছেলে টিফিন খাওয়ালো। যাদের সময় দিলো। সাহায্য সহযোগিতা করলো। তারাই আমার ছেলেকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করলো। আমার ছেলে স্কুল জীবন থেকে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। সে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল। রাজনীতির নেশায় সে এতটা বিভোর ছিল যে আমাদের বাধা বিপত্তিতেও সে দমতো না। শাবাব অত্যন্ত মেধাবী, আকর্ষণীয় চেহারা আর সাহসী হওয়ায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের কাছে অত্যন্ত পছন্দের ছিল। ওই নেতারাই তাকে নানাভাবে ফুসলিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় করেন। তারা শাবাবকে লোভ দেখাতেন আগামী জেলা কমিটিতে তাকে ভালো পদ দেয়ার। বাসায় আমাকে সে প্রায়ই বলতো আম্মা আমি আগামীতে জেলা কমিটির ভালো পদ পাব। আমি তখন বলতাম বাবা পদ দিয়ে তুমি কি করবা। তুমিতো কিছুদিন পরে দেশের বাইরে চলে যাবে। প্রতি উত্তরে
সে বলতো আম্মা রাজনীতি করলে পদ ছাড়া কাজের মূল্যায়ন হয় না। শাবাব সবসময়ই ছাত্র রাজনীতির কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকতো। এ কারণে বাসায় এমনকি পরিবার ও স্বজনদেরও তেমন সময় দিতে পারতো না। বাসায় থাকলেই ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা ভিড় করত। বিশেষ করে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মীরা আসতো। আমি ওদের জিজ্ঞেস করতাম তারা ওখানে কেন আসে। ওরা বলতো তারা ছাত্রলীগের কর্মী। শাবাব তাদের দলের বড় ভাই। সে নাকি তাদের নানা সমস্যা দেখভাল করে। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে প্রশ্ন রেখে বলেন, আমার ছেলে যাদের জন্য রাজনীতিতে সক্রিয় হলো-যারা আমার ছেলেকে রাজনীতিতে নিয়ে গিয়ে তাদের ফায়দা হাসিল করলো; তারা আজ কোথায়। তারা এখন নাকি বলছে আমার ছেলে ছাত্রলীগের কেউ না। তারা আগে কেন আমার বাসায় এসে ভিড় করতো। তিনি বলেন, তুষার তার পরিবার থেকে বিতাড়িত হলে আমাদের বাসায় আসতো। তার সঙ্গে ফাহিম ও প্রতীক আসতো। তাদের টিফিন খাওয়াতো শাবাব। অথচ গ্রুপিং দ্বন্দ্বে দলীয় হীনমন্যতায় তারাই তার ঘাতক হলো। গেল পৌর নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে সেলিনা রহমান বলেন, আমার ছেলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের দলের প্রার্থীকে জয়ী করালো। তখন মিষ্টি নিয়ে হাসিমুখে ওই নেতারা আমার বাসায় এসেছিলেন। এখন ওরা কোথায়। আমার ছেলে ছাত্রলীগের সক্রিয় নেতা থাকলেও সে নিহত হবার পর এখন পর্যন্ত আমাকে ও আমার পরিবারকে সান্ত্বনা দেয়াতো দূরের কথা ওরা কেউ বাসায়ও আসেনি। অথচ ওই নেতারাই আমার ছেলেকে দিয়ে সরকারি কলেজ ও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড চালাতে উৎসাহ যোগাতেন। বলতেন ওই প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিজের দলের কর্মী বৃদ্ধি করতে। আমার ছেলেকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে সিলেট মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটিতে আইন বিভাগে ভর্তি করালেও ওই নেতাকর্মীরাই রাজনৈতিক স্বার্থে তাকে আবার মৌলভীবাজারে নিয়ে আসেন। সে সরকারি কলেজে ডিগ্রিতে পড়া লেখা করতো। গেল প্রায় মাস তিন থেকে সে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক হয়। আগে তাকে বিদেশ যেতে বললে রাগ করতো। কিন্তু দলীয় রাজনীতির গ্রুপিং আর হিংসাপরায়ণতা তার আগের সিন্ধান্তকে অনেকটা বিচলিত করে। চলতি মাসের ১২ তারিখে তার পাসপোর্ট হাতে আসার কথা। আমেরিকায় সপরিবারে যাওয়ার আবেদন থাকলেও সে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কারণ ওখানে তার দু’বোন রয়েছেন। শাবাবের মা আক্ষেপ করে বলেন, আমার শাবাব দেশের চলমান নোংরা রাজনীতির জন্য প্রাণ দিলো। একই দল ও গ্রুপের সহকর্মী বন্ধুদের হাতে নির্মমভাবে খুন হলো। তিনি বলেন দেশের এমন ঘৃণ্য রাজনীতি যেন অচিরেই বন্ধ হয়। এভাবে যেন আর কোনো মায়ের বুক খালি না হয়। তিনি এই জোড়া খুনের ঘাতকদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে ফাঁসি বাস্তবায়ন করার জোর দাবি জানান। তার পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা জানান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিহত মাহি ঘটনার ২-৩ দিন আগে হন্তদন্ত হয়ে বাসায় এসে শাবাবের খোঁজ করছিল। তার কারণ জানতে চাইলে সে বলেছিল তাদের মধ্যে মারামারি হয়েছে। শাবাবের কাছে বিচার দিতে এসেছে। তার বিমর্ষ অবস্থা দেখে শাবাবের মা তাকে বসিয়ে পানি ও নাস্তা খাওয়ান। তারা বলেন তার সহপাঠী, বন্ধু ও সহকর্মী সূত্রে জেনেছেন তুষার ও তামিমের সঙ্গে দলীয় গ্রুপিং দ্বন্দ্বের কারণেই পূর্ব পরিকল্পিতভাবেই এই খুনের ঘটনা ঘটে। শাবাবের বাবা বলেন, শাবাব নামের অর্থ যুবক। সে বৃদ্ধ হওয়ার আগেই নোংরা রাজনীতির খপ্পরে পড়ে দুনিয়া ছাড়তে হলো। আমি দেশবাসীর কাছে এই হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। অপর দিকে কনকপুর ইউনিয়নের দুর্লভপুর গ্রামে একই অবস্থা। নিহত মাহির মা জুলেখা বেগম ও বাবা বিল্লাল মিয়া মৃত্যুশয্যায়। মা এই ঘটনার পর থেকে ছেলের শোকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। শোকের মাতম চলছে গোটা পরিবারে। কৃষক পরিবারের ছেলে মাহিই ছিল তার পরিবারের স্বপ্ন ও সম্ভাবনার আশা। এমনটি জানান তার মামা গোলাম ইমরান আলী।
মামলার এজাহার ও পরিবার সূত্রে জানা যায় দলীয় গ্রুপিং দ্বন্দ্বের কারণেই এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এই হত্যাকাণ্ডের অন্যতম হোতা ও পরিকল্পনাকারী ছিল তারই বন্ধু ও একই গ্রুপেরই কর্মী আনিসুল ইসলাম তুষার। মূলত দল ও গ্রুপের মধ্যে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এই খুনের ঘটনা ঘটে। মৌলভীবাজার থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায় রিমান্ডে থাকা তিন এজাহারভুক্ত আসামি রুবেল, কনক ও জামিল এ সময় উপস্থিত থাকলেও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল না বলে জানায়। এই মামলায় এখন পর্যন্ত এই তিনজন ছাড়া আর কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। তবে পুলিশ জানিয়েছে তারা আসামি ধরতে তৎপর রয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন