আবেদনপত্রে দালালের বিশেষ চিহ্ন দেখলেই দ্রুত হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। সহজে ছবি তোলা ও পাসপোর্ট পাচ্ছেন যথাসময়ে। এ জন্য দালালকে দিতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ।
গতকাল সরজমিনে চট্টগ্রাম মহানগরীর ডবলমুরিং থানার মনসুরাবাদ এলাকায় অবস্থিত বিভাগীয় পাসপোর্ট কার্যালয় ঘুরে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
তবে দালালদের উৎপাত ও বাড়তি টাকা নেয়া প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা কার্যালয়ের উপপরিচালক একেএম মাজহারুল ইসলাম বলেন, পাসপোর্ট কার্যালয়ে কোনো দালাল নেই। দালালদের বাড়তি টাকা দিয়ে কেউ পাসপোর্ট নিচ্ছে বলেও আমার জানা নেই।
জরুরি ও সাধারণ দুই ধরনের পাসপোর্টই পাওয়া যায় চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয় থেকে। জরুরি পাসপোর্টের জন্য সরকারি ফি ছয় হাজার টাকা এবং সাধারণ পাসপোর্টের সরকারি ফি তিন হাজার টাকা। ব্যাংকে ফি জমা দিয়ে রশিদ পাসপোর্টের আবেদনের সঙ্গে যুক্ত করতে হয়।
আবেদনপত্র জমা দেয়ার পর তোলা হয় ছবি। এরপর পুলিশের মাধ্যমে যাচাইয়ের পর নির্দিষ্ট সময়ে পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার কথা। কিন্তু গতকাল সকাল ১১টার দিকে পাসপোর্ট কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, মূল ফটকের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছেন আনসার সদস্য রেজাউল করিম। এ সময় সেখানে যান নগরের বাকলিয়া এলাকার বাসিন্দা সোহেল চৌধুরী। তিনি সাধারণ পাসপোর্ট করতে চান জেনে রেজাউল বলেন, সব আমি করে দেব। পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা দেবেন। আপনাকে কিছুই করতে হবে না। শুধু ছবি তুলে চলে যাবেন।
এত টাকা কেন সোহেল প্রশ্ন করতেই রেজাউলের জবাব, পরিচালক সাহেবের পিএর মাধ্যমে করাব এ পাসপোর্ট। কোনো অসুবিধা হবে না। তিন হাজার টাকা ব্যাংকে জমা দেব। দেড় হাজার টাকা অফিস খরচ। বাকিটা ভেরিফিকেশনের জন্য পুলিশকে দিতে হবে। তবে টাকা জোগাড় করে পরে আসবেন জানিয়ে চলে যান সোহেল।
এরপর রেজাউলের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায় হাটহাজারীর লাঙ্গলমোড়া থেকে আসা যুবক মুরাদকে। তিনি বলেন, সাড়ে ৫ হাজার টাকায় রেজাউলের মাধ্যমে পাসপোর্ট করতে দিয়েছি। ছবি তোলা হয়েছে। পাসপোর্ট কবে পাব জানতে এসেছি।
বাড়তি টাকা কেন দিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিজে ফরম পূরণ করে জমা দিলে নানা ভুলত্রুটি ধরে। দু-তিন দিন পরে ছবি তুলতে হয়। বাড়তি টাকা না দিলে হয়রানির শিকার হতে হয়। মুরাদ চলে যাওয়ার পর বাড়তি টাকা নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে অস্বীকার করেন রেজাউল। তিনি বলেন, মানুষ এলে তাদের সাহায্য করি।
আরো কিছুক্ষণ সেখানে অবস্থানের সময় কথা হয় সন্দ্বীপের মো. খোরশেদ ও খুলশী এলাকার রফিকুল আলমের সঙ্গে। দু’জনেরই অভিযোগ, তারা নিজেরা আবেদনপত্র জমা দিতে গেলে তা নেয়া হয়নি। পরে দালালের মাধ্যমে আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন।
খোরশেদ, রফিকুল ও কায়েসসহ আরো কয়েকজন আবেদনকারী জানান, দালালরা যেসব আবেদনপত্র জমা দেয় তাতে তারা বিশেষ চিহ্ন ব্যবহার করে। যেমন ইংরেজি ও বাংলা বর্ণমালার কোনো একটি বর্ণ বা নির্দিষ্ট কোনো স্থানে টিক চিহ্ন ইত্যাদি। এসব চিহ্ন দেখে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বুঝে ফেলেন যে আবেদনপত্রটি তাদের চিহ্নিত দালালের মাধ্যমে এসেছে।
পাসপোর্ট কার্যালয়ে তৎপর এমন এক দালাল বলেন, ভাই দীর্ঘদিন ধরে এ কাজে আছি। আর কোথায় যাব। কাজ না করলে খাব কি। দালালি করে যা পাই তা থেকে কিছু পাই। সব অফিসাররা নিয়ে নেয়। তবে সাংবাদিকদের যন্ত্রণায় বাঁচি না। তাই ছদ্মবেশে অফিসারদের দেয়া ‘বিশেষ চিহ্ন’ ব্যবহার করে কাজ করি। এ রকম বিশেষ চিহ্ন প্রাপ্ত ২৫-২৬ দালাল এখানে কাজ করে। এ ছাড়া নগরীর বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করেও অনেকে নিরাপদে এ কাজ করে বলে জানান তিনি।
জানা যায়, বছর খানেক আগে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট কার্যালয়ের ৬৫ জন দালালের একটি তালিকা তৈরি করে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই)। তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তালিকাটি পাঠানো হয় পুলিশকে। এরপর কয়েকজনকে আটক করা হলেও উৎপাত কমেনি দালালের। বরং দালালরা নগরীর বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে বিশেষ চিহ্ন ব্যবহৃত আবেদনপত্র আবেদনকারীকে দিয়ে পাঠায়।
ভুক্তভোগীরা জানান, চট্টগ্রাম পাসপোর্ট কার্যালয়ে প্রতিদিন অর্ধশতাধিক দালাল তৎপর থাকে। যারা সরকার নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত টাকা আদায় করে চুক্তিতে পাসপোর্ট করে দেয়। ফলে স্বাভাবিকভাবে পাওয়া কম সময়ে পাসপোর্ট পেয়ে যায় গ্রাহকরা। হয়রানির শিকার হয় দালালদের বিশেষ চিহ্নবিহীন আবেদনকারীরা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন