৪৬ বছর ধরে লাঠিকেই পা হিসেবে ব্যবহার করছেন শারীরিক প্রতিবন্ধী পঞ্চাশোর্ধ নারী মর্জিনা বেওয়া। এক পা হারানো মর্জিনার জীবন চলে এ বাড়ি ও বাড়ি ভিক্ষা করে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়লগ্নে মাইন বিষ্ফোরণে বাম পা ও বাম হাতের আঙুল হারিয়েছেন তিনি। মারাত্মকভাবে ঝলসে গেছে বুকসহ শরীরের উপরের অংশ। এখনও পোড়ার ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন অসহায় এ নারী।
মর্জিনা বেওয়ার বাস রাজশাহীর তানোর উপজেলা সদরের শতলীপাড়া এলাকায়। নড়বড়ে পাতার ঘরের মতো একটি জায়গায় মাথা গোঁজার ঠাঁয় তার। স্বামী হারিয়ে বোঝা হয়ে রয়েছেন দিনমজুর ছেলের সংসারে। নিত্য অভাব ভর করে রয়েছে তার সংসারে। বিধবাভাতা ছাড়া মেলেনি কোনো সহায়তা।
মর্জিনা বেওয়া যুদ্ধের বিভীষিকায় নিজের নামটিই হারিয়ে ফেলেছেন। সবাই তাকে ‘বোমফুটি’ নামেই চেনেন। গতকাল দুপুরে বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া গেলো।
তিনি জানান, ৭১ এ তার বয়স বারো কি তেরো। বাবা ইউসুফ প্রামাণিক ছিলেন প্রান্তিক কৃষক। তাদের বাড়ি ছিল থানা এলাকায়। বিল পেছনে ফেলে শিবনদী। শিবনদী পেরিয়ে থানা এলাকায় ঢুকতেই প্রথম বাড়িটি ছিল তাদের। বিলপাড়ি দিয়ে লোকালয়ে আসা পরিশ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিতেন গ্রামের লোকজন।
মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা আজো মনে পড়ে তার।তিনি বলেন, বাড়ির পেছনে বিলপাড়ে মুক্তি বাহিনী এসে সংগঠিত হতো। গ্রামের লোকজন যে যার মত করে তাদের সহায়তা দিতেন। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা তানোর হিন্দু পাড়ার নিশিত ও কার্তিক ত্রিনাথ, টুকুসহ আরও অনেকেই যুদ্ধ করছিলেন দেশমাত্রিকার টানে। এদের অনেকেই আজ বেঁচে নেই।তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকবাহিনীর ঘাঁটি ছিল থানায়। যুদ্ধের শেষ দিকে পাক বাহিনীকে বিতাড়িত করতে সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় মুক্তি বাহিনী। মাইন পোঁতা হয় আস্তানা এলাকায়। পাক বাহিনী এলাকা ছেড়ে যায় শেষ পর্যন্ত। এরপর ওই এলাকায় খড়ি সংগ্রহে গিয়ে পা দেন পেতে রাখা মাইনে। বিষ্ফোরণে তার বাম পা, বাম হাতের আঙুল হারান তিনি। মারাত্মকভাবে ঝলসে যায় বুকসহ শরীরের উপরের অংশ। খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তাকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে নেন। প্রাথমিকভাবে দেন অর্থ সহায়তাও। কিন্তু সেই অর্থে চিকিৎসা চলেনি শেষ পর্যন্ত। অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায় তার চিকিৎসা। ফলে বাধ্য হয়ে বাড়ি ফিরে আসেন তিনি। যুদ্ধের দিন পনেরো বছর বয়সেই এলাকার সাদের সরদারের সঙ্গে বিয়ে হয় তার।
তিনি জানান, শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও কখনও ভেঙে পড়েননি। সংসার গড়েছেন। তার একটি মাত্র ছেলে সন্তান। সেই ছেলেকে বিয়েও দিয়েছেন। নাতি নাতনি নিয়ে ৬ সদস্যের পরিবার তার। সংসার চলে দিনমজুর ছেলের আয়ে। সহায় সম্বলও নেই তার। বছর সাতেক হলো হারিয়েছেন স্বামীকে। লাঠিতে ভর দিয়ে ভিক্ষা করে সংসার চালান তিনি। আর বয়স্ক ভাতার ৪শ টাকা দিয়ে কোনো মতে যোগার করেন চিকিৎসার খরচা। তারপরও যাপিত জীবন নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই মর্জিনার।স্বাধীনতার সুখ কি তাও জানেন না তিনি। নেই কোনো দাবি-দাওয়া। দেশ স্বাধীন হয়েছে-এটিই তার কাছে বড় পাওয়া।
এ বিষয়ে তানোর থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল ওহাব শেখ বলেন, যুদ্ধকালীন সাধারণ জনতা যে যার মতো করে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন। অনেকেই প্রকাশ্যে আবার অনেকেই গোপনে সহয়তা করে গেছেন। সবাইকে সমানভাবে মূল্যায়ন করা যাবেনা। এদের একজন মর্জিনা বেগম।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন