রাজধানীর রমনা এলাকায় অবস্থিত ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি)। দেশের প্রকৌশলীদের সবচেয়ে বড় সংগঠনটির চত্বর সাজানো হয়েছে বর্ণিল সাজে। মূল গেটে নির্বাচনী ব্যানার। ভেতরে ঢুকতেই সামনে এসে একেরপর এক স্বেচ্ছাসেবী হাতে বিভিন্ন প্রার্থীর লিফলেট গুঁজে দিচ্ছেন। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় অনেকে তা হাতেও নিচ্ছেন। মূল ফটকের ভেতরের চত্বর ধরে সারি সারি স্টল সাজানো। সেখানেও প্রার্থীদের সমর্থকরা বসে আছেন। আছে বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠানের স্টলও। এর কিছু সামনে বিশাল প্যান্ডেল টাঙ্গিয়ে সারি সারি বুথ তৈরি করা হয়েছে। সেখানে প্রবেশের পথেও একদল স্বেচ্ছাসেবী লিফলেট বিলির জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। দেখে মনে হবে, লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিশাল ভোটযজ্ঞ চলছে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে।
কিন্তু মূল প্যান্ডেলের ভেতরে গিয়ে নির্বাচনী বুথগুলোর আশপাশ ঘুরলেই বোঝা যায় এ যেনো বজ্র আঁটুনি, ফস্কা গেরো। কারণ যে ভোটারদের জন্য এই বিশাল আয়োজন তাদের উপস্থিতি একেবারে নেই বললেই চলে। প্রার্থীর সমর্থক আর প্রার্থীরা নিজেরাই আড্ডা আর খাওয়া-দাওয়ায় যতটুকু সম্ভব সরগরম করে রেখেছেন ইনস্টিটিউশন চত্বর।
কথা বলতে চাইলে মূল প্যান্ডেলের সামনে দাঁড়ানো স্বেচ্ছাসেবীরা বলেন, তারা স্কাউট এবং অন্যান্য প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান থেকে এখানে এসেছেন। রাজু নামের এক তরুণ কিছুটা ব্যস্ততা দেখিয়ে জানান, তার শিক্ষক তাকে নির্বাচনের দিন এখানে কাজ করতে বলেছেন বলেই এসেছেন।
যতটা উৎসবমুখর ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হওয়ার কথা ততটা কি হচ্ছে- জানতে চাইলে ভোট দিয়ে বেরিয়ে আসা এক নারী প্রকৌশলী সোজা কোনো উত্তর না দিয়ে মুচকি হেসে বেরিয়ে যান।
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে শনিবার বেলা ২টা থেকে বিকাল ৫টায় ভোটগণনা শুরুর আগ পর্যন্তই ছিল এমন চিত্র। দেখা যায়, ২০-২৫ মিনিট পরপর একেকজন ভোটার আসেন। নিজেদের মতো ভোট দিয়ে চলে যান। রাজধানীসহ সারা দেশে ১৮টি সেন্টার এবং আরও ২০টি সাব-সেন্টারে হচ্ছে আইইবি’র নির্বাচন। যেখানে মোট ভোটার সংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার, তাহলে উপস্থিতি এতো কম কেন!
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, আইইবি’র নির্বাচন নিয়ে সাধারণ ভোটার এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা বঞ্চিত প্রকৌশলীদের তীব্র হতাশার কথা। এই হতাশা ছুঁয়ে গেছে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াতপন্থীসহ সাধারণ প্রকৌশলীদেরও।
আইইবি’র নির্বাচন নিয়ে জটিলতা শুরু হয় নির্বাচন কমিশন গঠনের পর থেকে। প্রথমেই একটি অংশ অভিযোগ তোলে- প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে পরিচিত কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিটির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রহমতুল্লাহকে একটি অংশ তাদের স্বার্থরক্ষা করতেই ওই চেয়ারে বসিয়েছে।
মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার পর মূল বিরোধ বাঁধে আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রকৌশলীদের মাঝেই। প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসেন, প্রকৌশলী নজরুল ইসলামসহ সরকার সমর্থক কয়েকজন এবং তাদের সমর্থকদের মনোনয়নপত্র একে একে বাতিল করা হয়।
এর বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হলে আদালত নির্বাচনের উপর স্থগিতাদেশ দেন। সেই স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট থেকে নিজেদের পক্ষে রায় নিয়ে নির্বাচন কমিটি আবার নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে।
কিন্তু এরইমধ্যে প্রকৌশলীদের এই সংগঠনটির গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন অনেকেই। কার্যনির্বাহী কমিটির ১০টি পদের সবক’টিতেই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যান সরকার সমর্থক প্রকৌশলীদের একাংশ। নির্বাহী কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সহসভাপতি চারজন এবং সহসাধারণ সম্পাদক চারজনের সবাই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। নির্বাহী কমিটির বাইরেও ঢাকা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ও সাধারণ সম্পাদকসহ আরও চার পদে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন সরকার সমর্থকদের একাংশ।
শনিবার মূলত আইইবি’র কাউন্সিলর সদস্যদের নির্বাচন চলছিল যারা ভবিষ্যতে সংগঠনটির কাউন্সিলর হিসেবে সিদ্ধান্ত নিবেন। সেখানেও বিভিন্ন বিভাগের প্রকৌশলীদের সাতটি আলাদা আলাদা ক্যাটাগরিতে নির্বাচন হয়েছে।
এরইমধ্যে অভিযোগ উঠে একেবারে দল নিরপেক্ষ প্রকৌশলীরাও মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। ক্ষেত্র বিশেষ ভুয়া সই দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়ন ওই প্রার্থীর অগোচরে তুলে নেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠে।
ড. ফরিদ উদ্দিন নামে এক স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জাল বলে বাতিল করে দেয়া হয়। এরইমধ্যে বিএনপিপন্থী প্রকৌশলীরা অভিযোগ করেন, তাদের মনোনয়নপত্র দেশের বিভিন্ন কেন্দ্রে জমা দিতে দেয়া হয়নি বা জমা দিলেও পরে অকারণে বাতিল করে দেয়া হয়।
বিএনপিপন্থী প্রকৌশলীদের নেতা ও আইইবি’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিয়া মুহাম্মদ কাউয়ুম পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, খুলনায় তাদের সমমনা প্রকৌশলীদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেয়া হয়নি। রাজশাহীতে বিনাকারণে মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। এমনকি কুমিল্লাতে মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেয়া হয়নি বলেও অভিযোগ করেন তিনি। এসব অভিযোগ নির্বাচন কমিশনকে জানানোর পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে তাদের অভিযোগ।
এই অবস্থায় বিএনপিপন্থী ছাড়াও আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রকৌশলীদের একটি বড় অংশসহ সাধারণ প্রকৌশলীদের অনেকেই নির্বাচন থেকে তাদের সরিয়ে নেন। একটি বড় অংশ শেষ মুহূর্তে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। এই প্রকৌশলীদের কেউই নির্বাচনে ভোট দিতেও যাননি।
মিয়া মুহাম্মদ কাইয়ুম অভিযোগ করেন, আইইবি-কে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে, সব শেষ! ৫ জানুয়ারি মডেলের একটি নির্বাচন করে নিয়েছে। এই প্লট (ষড়যন্ত্র) আগে থেকে তৈরি করেছে।
তিনি বলেন, ৫ জানুয়ারিতেও তো কিছু ভোট পড়েছিল, আইইবি-তে সেটাও হয়নি।
নির্বাচন চলাকালে আইইবি’র কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিটির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রহমতুল্লাহর দেখা মিলে মূল প্যান্ডেলের সামনে। তার সঙ্গে ছিলেন প্রকৌশলী ড. দীপক কান্তি দাশ।
পরিচয় জানাতেই তারা দু’জনেই প্রায় সমস্বরে হাস্যোজ্জ্বল মুখে দাবি করেন, অনেক ভালো নির্বাচন হচ্ছে। যা আশা করেছিলাম তার থেকে অনেক বেশি ভোটার আসছে।
সব অভিযোগ অস্বীকার করে মো. রহমতুল্লাহ বলেন, খুলনা, রাজশাহী বা কুমিল্লার যেসব অভিযোগের কথা বলা হচ্ছে, সেসব বিষয়ে তিনি লিখিত অভিযোগ পাননি। পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতেন। অভিযোগকারীদের তাদের অভিযোগ লিখিত আকারে দিতে বলেছিলেন বলেও দাবি তার।
নির্বাচন পরিচালনাকারী এই দুই প্রকৌশলী দাবি করেন, ‘সো-কল্ড (তথাকথিত) বিএনপিপন্থী’ প্রকৌশলীরা নির্বাচন বয়কট করেছে।
প্রকৌশলী রহমতুল্লাহ বলেন, বিএনপিপন্থী মুহাম্মদ কাইয়ুমকে তিনি নির্বাচনে থাকার জন্যে টেলিফোনে একাধিকবার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও তাদের দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে নির্বাচনে থাকতে পারেননি।
এই দুই কর্মকর্তা দাবি করেন, একটি অংশ একবার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে আবার তা বহাল রাখার জন্য দাবি তোলায় সেসব দাবি রাখা যায়নি।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগপন্থী প্রকৌশলী এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘এটা একটা ছেলে খেলার নির্বাচন হয়েছে। এই ছেলেখেলার কারণেই আমিও যাইনি ওখানে। আমি ঢাকার বাইরে চলে এসেছি।’
তিনি বলেন, গত একমাসে এতোবড় নির্বাচন নিয়ে আইইবি-তে কোনও উচ্ছ্বাস নেই। সাধারণ প্রকৌশলীরা ওখানে যান না। কারণ তারা মনে করেন, আইইবি’র যে উদ্দেশ্য তা এই নির্বাচনের মাধ্যমে নষ্ট হয়েছে। সাধারণ প্রকৌশলীদের তাই কথা বলার কোনো পথ থাকল না।
নজরুল ইসলাম বলেন, আইইবি’র ৯০ ভাগ প্রকৌশলী সরাসরি রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করেন না। কিন্তু এবার নির্বাচন ঘিরে যে অবস্থা তৈরি হয়েছে সে প্রেক্ষাপটে ৯০ ভাগ প্রকৌশলীই ভোট দিতে যাননি।
তিনি দাবি করেন, একটি যোগ্য বড় অংশকে ক্ষমতার জোরে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা হয়েছে। এখন যারা নির্বাচন করছেন, তারা নির্বাচনের বাইরে থাকাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কোনোভাবেই জিততে পারতো না।
এই প্রকৌশলী আরও বলেন, নির্বাচন ঘিরে বিএনপিপন্থীরা ভুল করে ফেলেছে। তারা যদি শেষ মুহূর্তে নির্বাচন থেকে সরে না যেত, তাহলে এতোটা স্বেচ্ছাচারিতা করতে পারতো না। তারা সরে যাওয়াতে এখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন