ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী খন্দকার মোশতাক আহমদের ছবি নিয়ে শুরু হওয়া বিতর্কের মধ্যে মেলা কর্তৃপক্ষ ওই ছবির উপরের দিকে ছোট্ট করে ক্রস চিহ্ন দিয়ে রেখেছে।
কর্তৃপক্ষের এমন উদ্যোগকে দায়সারা উল্লেখ করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলছেন, ‘এভাবে শুধু ক্রস চিহ্ন দিয়ে হয়তো দায় সারা যাবে। কিন্তু এই ক্রস চিহ্নের অর্থ আমাদের তরুণ প্রজন্ম কী বুঝবে? তাদের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে।’
১০ জানুয়ারি এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে চ্যানেল আই অনলাইন। তারপর পর ১১ ও ১২ জানুয়ারি আরও কয়েকটি অনলাইনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম এ নিয়ে খবর প্রকাশ করে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) আয়োজনে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ প্যাভিলিয়নে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের উপর আঁকা ২৬টি চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে বিশ্বজিৎ গোস্বামীর আঁকা ২৩ নম্বর চিত্রে দেখা যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ছবির সঙ্গে খন্দকার মোশতাককে দেখা যায়।
চ্যানেল আই অনলাইনের সংবাদে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বিস্ময় প্রকাশ করে বিষয়টাকে অনুচিত বলে জানান। খন্দকার মোশতাকের ছবি মার্ক করে পাশে ক্যাপশনের তার বিশ্বাসঘাতকতার কথা লিখে দেওয়ার দাবি জানান।
শনিবার বাণিজ্যমলায় গিয়ে দেখা যায় বিশ্বজিৎ গোস্বামীর আঁকা ছবিতে খন্দকার মোশতাকের মাথার পাশে ছোট করে ক্রস চিহ্ন এঁকে দেওয়া হয়েছে। তবে এই ক্রস চিহ্ন দিয়ে কী বোঝানো হয়েছে তা লেখা নেই কোথাও।
ক্রস চিহ্ন দেওয়ার আগের ছবি।
এ বিষয়ে চ্যানেল আই অনলাইনকে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘ইতিহাসের নায়ক এবং খলনায়ক সবাই থাকবে। কিন্তু খলনায়ককে চিহ্নিত করে দেওয়া উচিত। মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণের ছবি যদি ছাপাতে হয় তাহলে অবশ্যই খন্দকার মোশতাককে চিহ্নিত করে তার বিশ্বাস ঘাতকতার কথা ক্যাপশনে লিখে দিতে হবে।’
চ্যানেল আই অনলাইনকে মোশতাক আহমেদের ছবিতে শুধু ক্রস চিহ্ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এমনিতে নানা সময়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। শুধু ক্রস চিহ্ন দিয়ে তো বোঝানো যাবে না খন্দকার মোশতাক কিভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যায় সম্মতি দিয়েছিল। কিভাবে পরবর্তীতে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করেছিল।’
তবে কিছুই না থাকার চেয়ে পাশে একটা ক্রস চিহ্ন দেওয়ার উদ্যোগে স্বাগত জানিয়ে শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘এই ছবি সরাতে হবে। ১৯৭১ সালের তোলা ছবি হলে তাও মেনে নেওয়া যায়। একটা আঁকা ছবিতে বিশ্বাসঘাতকের উপস্থিতি কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।’
ওই স্টলের দায়িত্বরত রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো বিষয়টি ভালো বলতে পারবে।’
সেখানে সম্পাদনা পরিষদ সদস্য হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসির মামুনের নাম রয়েছে।
চ্যানেল আই অনলাইনের পক্ষ থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে বলেন, ‘এমন ছবি থাকলে সমস্যা কী?’
দর্শকদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় বিষয়টি উল্লেখ করার পর মুনতাসির মামুন বলেন, ‘আমি আসলে কিছুই জানি না। ছবি নির্বাচনের সঙ্গে যুক্তও ছিলাম না। ছবিটি এখনো দেখা হয়নি। দেখলে বলতে পারবো। তবে এমন ছবি দেওয়ার সময় অবশ্যই খন্দকার মোশতাকের ভূমিকা উল্লেখ করা উচিত।’
বিশ্বজিৎ গোস্বামীর আঁকা ওই চিত্রে দেখা যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ছবির সঙ্গে রাখা হয়েছে খন্দকার মোশতাককে। এই ছবিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পাঁচ মন্ত্রীর শপথ গ্রহণের চিত্র।
আম বাগান, হাজারো জনতা ও মন্ত্রীদের শপথের সেই ছবির বড় একটা অংশ জুড়ে আছেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। তার সামনে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অংশ হিসেবে শপথ নেওয়া পাঁচ মন্ত্রী। সামনের সারিতে আছেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও খন্দকার মোশতাক আহমেদ।
বঙ্গবন্ধুর খুনের পরিকল্পনার সাথে জড়িত খন্দকার মোশতাক আহমেদকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই ফ্রেমে রাখায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন দর্শনার্থীরা।
বঙ্গবন্ধু হত্যায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত খুনিদের একজন মেজর সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে খন্দকার মোশতাক আহম্মদ এবং মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদের মধ্যে পঁচাত্তরের ১৪ আগস্টের একটি বৈঠকের বর্ণনা দেয়।
শাহরিয়ার রশিদ সেখানে বলেন, সেদিন বিকেলে মেজর রশিদ এবং মেজর নূর তাকে মন্ত্রী খন্দকার মুশতাকের আগামসি লেনের বাসায় নিয়ে যায়। যাবার পথে তারা গাড়ি রেখে যায় চানখারপুলে। তাদের মধ্যে এমন আলোচনা হয় যাতে পরদিন সকালে খন্দকার মোশতাক তার বাসায়ই অবস্থান করে।
আরেক খুনি মেজর ফারুকও তার জবানবন্দিতে স্বীকার করে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগের দিন খন্দকার মোশতাকের আগামসি লেনের বাসায় শেষ বৈঠক হয়। ওই বৈঠকেই ঠিক হয়ে যায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাকই হবে রাষ্ট্রপতি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন