ঐতিহাসিক যশোর রোডের শতবর্ষী রেন্ট্রিগাছগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ শুরু করতেই এই উদ্যোগ নিয়েছেন সরকারি দপ্তর। যার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন জাতীয় সংসদের প্রতিনিধিবৃন্দসহ স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা। শিগগির শুরু হচ্ছে দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল সড়কের চার লেনে উন্নীতকরণের কাজ। ইতিমধ্যে সড়ক বিভাগ যশোর রোড নির্মাণকাজের দরপত্র আহ্বান করেছে। তোড়জোড় চলছে এই রোডের শতবর্ষী প্রায় ২৩৩১টি রেন্ট্রিগাছ টেন্ডারের মাধ্যমে কেটে ফেলার। গত ৬ই জানুয়ারি যশোর কালেক্টরেট সভা কক্ষে জেলা প্রশাসক আশরাফ উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের এক বিশেষ সভায় ওই মহাসড়কের দুই ধারে থাকা রেন্ট্রি গাছগুলো কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এর আগে ৩১শে ডিসেম্বর যশোর ঈদগাহ ময়দানের জনসভায় বক্তৃতা করার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঐতিহাসিক যশোর রোডের যশোর থেকে বেনাপোল অংশের ৩৮ কিলোমিটার সড়কের চার লেনে উন্নীত করণের কাজ উদ্বোধন করেন।
যার প্রেক্ষিতে ৬ই জানুয়ারি শনিবার সকালে যশোর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে ‘যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক যথাযথ মানের ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ প্রকল্পের আওতায় রাস্তার দুই পার্শ্বে গাছসমূহ অপসারণের বিষয়ে’ এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় জানানো হয়, গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীতকরণের জন্য ইতিমধ্যে টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। শিগগির এই কাজ শুরু হবে। কিন্তু বর্তমানে মহাসড়কটির দুই পাশে নতুন-পুরনো অনেক গাছ রয়েছে। সেগুলো রেখে মহাসড়ক চার লেন করা সম্ভব না। সে কারণে জনস্বার্থে গাছ কাটতে হবে। সভা সূত্র জানায়, গাছ কাটার ব্যাপারে উপস্থিত সরকারি কর্মকর্তা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কেউ দ্বিমত পোষণ না করায় তা সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত আকারে গৃহীত হয়। রাস্তা নির্মাণের পর দুই ধারে নতুন করে যে গাছ রাস্তার ক্ষতি করবে না এমন বৃক্ষ রোপণের সিদ্ধান্তও নেয়া হয় ওই সভা থেকে।
সভায় অন্যান্যের মধ্যে কাজী নাবিল আহমেদ এমপি, শেখ আফিল উদ্দিন এমপি, অ্যাডভোকেট মনিরুল ইসলাম এমপি, সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব বেলায়েত হোসেন ও আব্দুল মালেক, স্থানীয় সরকার বিভাগ, খুলনার পরিচালক হোসেন আলী খন্দকার, যশোর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন, যশোর প্রেস ক্লাবের সভাপতি জাহিদ হাসান টুকুন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) হোসাইন শওকত, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুজ্জামানসহ সরকারি কর্মকর্তা ও গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক আশরাফ উদ্দিন জানান, গাছ কাটার ব্যাপারে যশোর, ঝিকরগাছা ও শার্শা উপজেলা পরিষদ এবং যশোর জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় আগেই সিদ্ধান্ত হয়। বিদ্যমান গাছ নিয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং জেলা পরিষদের মধ্যে যে বিরোধ আছে, তা আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় নিষ্পত্তি করা হবে। তবে সরকারি ওই সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির যশোর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও দলের পলিট ব্যুরোর সদস্য কমরেট ইকবাল কবির জাহিদ। তিনি বলেন শতবর্ষী ওই গাছ না কেটেও যশোর রোডকে চার লেনে উন্নীত করা সম্ভব। উদাহরণ হিসেবে তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পেট্রাপোল হয়ে বনগাঁ পেরিয়ে কলকাতার গঙ্গাঘাট পর্যন্ত প্রায় ১শ’ কিলোমিটার রাস্তাকে চার লেনে উন্নীতকরণের কাজ যে ভাবে সম্পন্ন হয়েছে সে ভাবে যশোর অংশের কাজ সম্পন্ন করার চিত্র তুলে ধরেন। তবে যশোর সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, যেভাবে প্রকল্পটি পাস হয়েছে ঠিক সেভাবে কাজটি সম্পন্ন করতে হলে পুরোনো এসব গাছ কাটার কোন বিকল্প নেই। তিনি বলেন ইতিমধ্যে রাস্তা নির্মাণের টেন্ডার আহ্বান করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তা এই মাসের মধ্যে সম্পন্ন হলে আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে যশোর বেনাপোল রোডের চার লেনের কাজ শুরু হবে। তবে রাস্তার একাংশের গাছ ডিভাইডারের মধ্যে রেখে নকশা অনুমোদন করা যেত কিনা এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি নির্বাহী প্রকৌশলী। এদিকে দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে স্মৃতিযুক্ত এসব বৃক্ষ নিধন না করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ঝড় উঠতে শুরু করেছে।
এদিকে স্থানীয় একটি মহলের বক্তব্য হচ্ছে, জেলার সব রাস্তা জেলা পরিষদের অন্তর্ভুক্ত। তাই এই গাছ কাটা বা রাখার সিদ্ধান্ত জেলা পরিষদের ওপর বর্তায়। এ বিষয়ে যশোর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল জানান, জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলার মাসিক উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় উপস্থিত সকলেই সর্বসম্মতিক্রমে গাছ কাটার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কারণ শতবর্ষী ওই গাছগুলোর অধিকাংশ অকেজো হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক এই সড়কটি চলাচলের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। তা দ্রুত সংস্কার বা পুনঃনির্মাণ করা প্রয়োজন। আর তা করতে হলে এই গাছ কাটার কোনো বিকল্প নেই। তিনি আরো জানান, অনেক গাছ ইতিমধ্যে মরে শুকিয়ে গেছে। তাই নতুন রাস্তা নির্মাণের পর দুই ধারে শোভাবর্ধনকারী গাছ লাগানো হবে।
কেন যশোর রোডের গাছ বিখ্যাত?
এই মহাসড়কটি ঐতিহাসিকভাবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে যশোর পর্যন্ত বিস্তৃত। বৃটিশ শাসন আমলে যশোর শহরে একটি বিমানঘাঁটি স্থাপন করা হয়। সেই সময়ে এই বিমানঘাঁটির সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য যশোর রোড আধুনিকভাবে নির্মাণ করা হয়। যশোর রোড নির্মাণের আগে এটি ছিল শের শাহের গ্রান্ড ট্র্যাঙ্ক রোড নামে পরিচিত। যশোর রোড নির্মাণের পর এই রোডের দুই ধারে যশোরের তৎকালীন জমিদার কালি পোদ্দার এই রেন্ট্রি বৃক্ষ গুলো লাগান। কথিত আছে জমিদার মাতা যশোর থেকে কলকাতার গঙ্গাঘাটে গঙ্গা স্নানে যাবেন তাই মায়ের মাথার ওপর শীতল শায়া শোভা বর্ধনের জন্য জমিদার কালী পোদ্দার ইে রেন্ট্রি বৃক্ষ রোপণ করেন। কিন্তু কালের গর্ভে বাংলাদেশ অংশে যশোর রোড নামটি বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে সড়ক বিভাগের কাগজপত্রে এটি বেনাপোল সড়ক নামে পরিচিত। তবে ভারতে পশ্চিমবঙ্গে এটি এখনো যশোর রোড নামে খ্যাত। এই রোডকে ঘিরে ১৯৭১ সালে বিখ্যাত শিল্পী কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ নামে একটি কবিতা লেখেন। পরবর্তীতে গায়ক বব ডিলান এবং অন্যদের সহায়তায় সেই কবিতাকে তিনি গানেও রূপ দিয়েছিলেন। যে গানটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশ্বজনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল বলে মনে করেন ঐতিহাসিকবৃন্দ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন