ঝালকাঠির রাজাপুরের মঠবাড়ী ইউনিয়নের মানকি সুন্দর গ্রামে তৈরি করা হয়েছে ভূমিহীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প। এই প্রকল্পের বাসিন্দাদের জন্য সরকারি অর্থায়নে নির্মাণ করা হয় ২৫টি একতলা ভবন। ঘরগুলো প্রকৃত দরিদ্র ভূমিহীনদের মধ্যে বরাদ্দ না দিয়ে বিত্তবান, প্রভাবশালী ও চাকরিজীবীদের দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আবেদন করেও ঘর না পেয়ে ভূমিহীন ২০ পরিবারের পক্ষ থেকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বরাদ্দ কমিটির সভাপতি রাজাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফরোজা বেগম পারুলের কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, একটি চক্র ৩০ হাজার থেকে ৫৫ হাজার টাকার বিনিময়ে বিত্তবান, প্রভাবশালী ও চাকরিজীবীদের নামে ১১টি ঘর বরাদ্দ দিয়েছে। টাকা দিতে না পারায় প্রকৃত ভূমিহীন পরিবারগুলো আশ্রয়ণ প্রকল্পের সরকারি ঘর থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
জানা যায়, সম্প্রতি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বরাদ্দের জন্য আবেদন করার আহ্বান জানায় প্রকল্পের ঘর বরাদ্দ কমিটি। এতে ৮৬টি পরিবার আবেদন করে। তাদের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে ২৫টি পরিবারকে প্রাথমিকভাবে মনোনীত করা হয়। বাছাই করা ২৫টি পরিবারের মধ্যে ১১টি পরিবার বিত্তবান, প্রভাবশালী ও চাকরিজীবী। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় যশোর সেনানিবাসের ১২ ফিল্ড আর্টিলারির তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রায় ৬৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা ব্যয়ে এক একর ২৫ শতাংশ জমিতে পাঁচটি ব্যারাকে ২৫টি একতলা পাকা ভবন (ঘর) নির্মাণ করে। তিন কক্ষবিশিষ্ট প্রতিটি ঘর একটি পরিবারের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। রয়েছে আলাদা বাথরুম ও বিশুদ্ধ পানির গভীর নলকূপ। আবেদন করেও আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর না পাওয়া উপজেলার পুখুরিজানা গ্রামের মৃত কাছেম খানের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম (৫৮) অভিযোগ করেন, তিনি স্থানীয় মালেক হাওলাদারের বাড়ির জমিতে বাঁশ খুঁটির ভাঙা একটি খুপরি ঘরে বসবাস করছেন। বিষখালী নদীর ভাঙনে গৃহহারা এ নারী মানুষের বাড়িতে কাজ করে দুমুঠো খাবার জোগার করেন। ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় ত্রাণের ঘর তাঁর নামে বরাদ্দ হলেও নিজস্ব জমি না থাকায় সেই ঘর থেকেও তিনি বঞ্চিত হন। প্রভাবশালী ও বিত্তবানদের দাপটে ঘর মেলেনি মানকি সুন্দরের আশ্রয় প্রকল্পেও।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর বরাদ্দ পাওয়া উপজেলার মানকি গ্রামের মৃত মধু হাওলাদারের ছেলে অবিবাহিত মো. জলিলের বাড়িতে চৌচালা একটি বড় টিনের ঘর ও মাঠে দুই একর জমি থাকা সত্ত্বেও তাঁর নামে এক পরিবারের ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। উপজেলার ডহরশংকর গ্রামের মৃত আব্দুল কাদের বেপারীর ছেলে মো. আহসান হাবিবের বাড়িতে দ্বিতল বিশিষ্ট টিনের বড় ঘর রয়েছে। তাঁর পুকুরে সরকারিভাবে মাছ চাষ প্রকল্প চলছে। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে পাওয়া ১০ লাখ টাকা সোনালী ব্যাংকে জমা আছে। তিনি নিজে একটি কম্পানির গাড়ির ড্রাইভারের চাকরি করেন। এ ছাড়া দুই একর ফসলি জমি থাকা সত্ত্বেও তাঁর নামে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। উত্তর পুখুরিজানা গ্রামের দেলোয়ার মোল্লার স্ত্রী কমলা বেগমের বাড়িতে ত্রাণের টিনের ঘর আছে। বসতবাড়ির জমি থাকা সত্ত্বেও তাঁর নামে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। পুখুরিজানা গ্রামের মৃত আমির হোসেন খানের ছেলে মিজানের বাড়িতে বড় টিনের ঘর, বসতবাড়ির জমি ও ঢাকার গাজীপুরে ক্রয়কৃত পাঁচ শতাংশ জমি থাকা সত্ত্বেও তাঁর নামে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পুখুরিজানা গ্রামের মৃত মোফাজ্জেল হাওলাদারের ছেলে খলিলুর রহমানের ছেলের বাড়িতে ত্রাণের ঘর রয়েছে, বাড়ি ও মাঠে প্রায় এক একর জমি, সাতটি গরু আছে ও আর্থিক সচ্ছল থাকা সত্ত্বেও তাঁর নামে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। উপজেলার মানকি গ্রামের শামসের আলীর ছেলে মশিউর রহমান মন্টুর বাড়িতে বড় ঘর, দুই একর জমি, বাবার করা ভবন এবং স্বামী-স্ত্রীর উভয়ে একটি সংস্থায় চাকরি করা সত্ত্বেও আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন। উত্তর পুখরিজানা গ্রামের আউয়াল হাওলাদারের স্ত্রী দেলোয়ারা বেগমের ঝালকাঠি শহরে ব্যবসা রয়েছে, ১৫ শতাংশ জমির বাগানবাড়ি সত্ত্বেও আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তাঁর নামে। একইভাবে জুলফিক্কার আলীর ছেলে মোস্তফার জমি রয়েছে। মোতালেব হাওলাদারের ছেলে রাসেলের জমি রয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মৃত খলিলুর রহমানের স্ত্রী রুলিয়া বেগমসহ ১১ জন ব্যক্তি বিত্তবান হওয়া সত্ত্বেও আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঘর বরাদ্দ না পাওয়া কয়েকজন গৃহহীন ব্যক্তি জানান, প্রতিটি ঘর বরাদ্দের আগে স্থানীয় একটি চক্র (তাদের নাম বলা যাবে না) তাঁদের কাছে ৩০ থেকে ৫০ হাজার করে টাকা দাবি করেছিলেন। যারা টাকা দিতে পেরেছে, তাদের নামে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আর যারা পারেনি, তাদের ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। ঘর বরাদ্দ পাওয়া আহসান হাবিব বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছে ঘর না পাওয়া অনেকে। আমি প্রকৃত গৃহহীন, তাই আমাকে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’
মানকি সুন্দর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বরাদ্দ কমিটির সভাপতি রাজাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফরোজা বেগম পারুল বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে মনোনীত ২৫টি পরিবারের মধ্যে ১১টি ধনী পরিবার ঘর পেয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ঘরবঞ্চিত ২০টি পরিবার। ধনী ব্যক্তিরা ঘর পেলে তদন্ত করে তা বাতিল করা হবে। প্রকৃত সহায়-সম্বলহীনদেরই ঘর বরাদ্দ দেওয়া হবে। যারা তাদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিয়েছে বা চেয়েছে, তাদের পরিচয় জানার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন