রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনার দীর্ঘদিনের প্রয়াস-প্রচেষ্টা তেমন ফল দেয়নি। ঘুরে-ফিরে আট পণ্যে আটকে আছে রপ্তানিখাত। মোট রপ্তানি আয়ের ৯৬ শতাংশই আসে এই পণ্যগুলো থেকে। অথচ সাড়ে পাঁচ হাজার পণ্য রয়েছে রপ্তানি তালিকায়। এই আট পণ্যের মধ্যে আবার তৈরি পোশাকের প্রভাব নিরঙ্কুশ। অথচ রপ্তানি পণ্যে বহুমুখিতা আনতে না পারলে দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে ভারসাম্য আনা যাবে না। অন্যদিকে গুটিকয়েকত পণ্যের উপর নির্ভরতাও দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য মোটেও ইতিবাচক হবে না।
প্রাপ্ত সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট রপ্তানি আয়ের ৮২ দশমিক ৪৭ শতাংশ এসেছে পোশাকখাত থেকে। আবার পোশাকখাতের মধ্যেও বৈচিত্র্য সংকট রয়েছে। ঘুরে-ফিরে কমদামের গতানুগতিক গোল গলার গেঞ্জি এবং মৌলিক মানের ট্রাউজার থেকে খুব একটা বেরিয়ে আসা যাচ্ছে না। এসব পণ্যের দরও অত্যন্ত কম। ৩ থেকে ৫ ডলারের বেশি নয়। গত বছর ঢাকায় অনুষ্ঠিত অ্যাপারেল সামিটে বলা হয়, শুধু সস্তা শ্রমের পুঁজির ভরসায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খুব বেশি দূর এগোতে পারবে না। প্রতিযোগিতার বিশ্ববাজারে শক্তিশালী অবস্থানের জন্য কমদামের পোশাক থেকে বেরিয়ে বেশি দামের পোশাকের দিকে উদ্যোক্তাদের মনোযোগ বাড়াতে হবে।
গত কয়েক বছরের রপ্তানির পরিমাণ বিশ্লেষণ থেকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) শীর্ষ আট পণ্যের তালিকা করে আসছে। সংস্থার এ তালিকার পণ্যগুলো হচ্ছে- পোশাকের ওভেন (শার্ট, প্যান্ট), নিট (গেঞ্জি জাতীয় পোশাক), হোম টেক্সটাইল, হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ, পাট ও পাটপণ্য, চামড়া ও চামড়াপণ্য, কৃষিজাত পণ্য ও প্রকৌশল পণ্য। এ আট পণ্যের রপ্তানিও সম্ভাবনা অনুযায়ী প্রত্যাশিত হারে বাড়ছে না।
গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট আয়ে নিটের অবদান ছিল ৪৩ দশমিক ২৫ শতাংশ, ওভেনের ৩৯ দশমিক ২২ ও হোমটেক্সের ২ দশমিক ২৮ শতাংশ। এ ছাড়া চামড়া ও চামড়াপণ্যের ৩ দশমিক ৭৪, হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ ২ এবং পাট ও পাটপণ্য ৩, কৃষিজাত পণ্য ১ দশমিক ৭১ ও প্রকৌশল পণ্য ১ দশমিক ৫০ শতাংশ। দেশি-বিদেশি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা এবং বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, এখনো নীতিসহায়তার মূলধারার বাইরেই রয়ে গেছে চার হাজার উদ্যোক্তা। এ কারণে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা সত্ত্বেও প্রত্যাশিত গতিতে এগোচ্ছে না বাংলাদেশের রপ্তানি।
গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) জিএসপি মূল্যায়ন বৈঠকে বলা হয়, রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্যের অভাবে ইইউসহ অন্যান্য বাজারে প্রবেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ২০০১ সাল থেকে এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ) কাঠামোর অধীনে অস্ত্র ব্যতীত সব পণ্যে ইইউর ২৮ দেশে শুল্কমুক্ত সুযোগ ভোগ করছে বাংলাদেশ। ২০১০ সালে উৎস বিধিতে দ্বিস্তরের শর্ত অর্থাৎ, দেশী কাপড় ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা থেকেও বাংলাদেশকে রেহাই দেয়া হয়। এরপর থেকে এক স্তর শর্ত অর্থাৎ, যে কোনো দেশের কাঁচামাল ব্যবহারে উৎপাদিত পণ্যেও জিএসপি সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। তারপরও একমাত্র তৈরি পোশাক ছাড়া আর কোনো পণ্যের রপ্তানি উল্লেখযোগ্য নয়। এজন্য বাংলাদেশের পণ্যের বৈচিত্র্য না থাকা, মানবসম্পদে দুর্বলতা ও গবেষণা উন্নয়নে যথেষ্ট মনোযোগের অভাবকে দায়ী করা হয়।
‘সেলাই থেকে সমৃদ্ধি’ শীর্ষক ঢাকায় প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এখনো উচ্চমূল্যের পোশাকে সেভাবে যেতে পারেনি বাংলাদেশ। এখানে কমদামের পোশাকই বেশি উৎপাদন হয়। উচ্চমূল্যের পোশাকে যাওয়া এবং চলমান সংস্কার শেষ করতে পারলে বাংলাদেশের পোশাকের রপ্তানি অন্তত ১০ শতাংশ বাড়তে পারে বলে আভাস দেয়া হয়। গত বছরের এপ্রিলে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) মতে, পোশাকখাতের বাইরেও চার হাজার উদ্যোক্তা আছেন, যাদের রপ্তানি বছরে এক মিলিয়ন (১০ লাখ) ডলারের বেশি নয়। এসব উদ্যোক্তাদের রপ্তানিখাতের মূলপ্রবাহে তুলে আনা গেলে রপ্তানি আয় একটা অবিশ্বাস্য অঙ্কের ঘরে যেতে পারতো। রপ্তানিতে দীর্ঘদিনের সংকট কাটাতে একমাত্র সমাধান হচ্ছে, পোশাকখাতে যেসব সুবিধা দেয়া হচ্ছে, সেগুলো অন্য সব রপ্তানি খাতকেও দেয়া। যেমন শুল্কমুক্ত কাঁচামাল এবং যন্ত্রপাতি আমদানি সুবিধা, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে স্বল্পসুদে ঋণ দেয়াসহ সব ধরনের সুবিধা।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) মতে, অনেক দেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকা সত্ত্বেও উৎপাদন পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে ব্যবসা পরিচালনায় অদৃশ্যমান ব্যয়, প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা, ব্যবস্থাপনা দুর্বলতা, গবেষণা এবং উদ্ভাবনীর অভাব, দক্ষ শ্রমিকদের ঘাটতি ও দুর্বল এবং অপ্রতুল অবকাঠামোর কথা বলেন তিনি। সম্ভাবনা অনুযায়ী, প্রত্যাশিত রপ্তানি চাইলে এসব দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে মনোযোগ দিতে হবে।
ব্রেকিংনিউজ/
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন