স্যার আমি বিকাশ থেকে বলছি। আপনার প্রবলেম সম্পর্কে অবগত আছি। এখনই সল্ভ করে দিচ্ছি। বিকাশের নামে ফাঁদে ফেলার কৌশলের প্রথম ধাপ এটি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘটে যায় ঘটনা। কেড়ে নেয়া হয় একাউন্টের সব অর্থ।
এভাবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র। এ চক্রের সদস্যদের সন্ধানে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দারা। এক শ্রেণির বিপথগামী, তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে সচেতন, আচরণে স্মার্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে প্রতারক চক্র। বিভিন্ন টেলিকম কোম্পানির বা বিকাশের কাস্টমার কেয়ারে কর্মরতদের মতোই সুন্দর ভাষায় কথা বলে তারা। এরকম কয়েকটি ভয়েস রেকর্ড থেকে জানা যায়- ১৩ই ডিসেম্বর প্রতারণার শিকার হন টাঙ্গাইলের সখীপুর থানার হতেয়া কেরনিপাড়ের বাবুল হোসেনের পুত্র জুবাইর হাসান। মুজিব কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র জুবাইর।
ওই দিন দুপুরে সাভার থেকে জুবাইরের চাচা তার বিকাশ নম্বরে ৪ হাজার টাকা পাঠান। জুবাইরের বিকাশে তখন প্রায় ১০ হাজার টাকা। বিকালে টাকা ক্যাশ আউট করতে দোকানে যাওয়ার পথেই একটি কল আসে তার ফোনে। অপরপ্রান্ত থেকে জানানো হয়, দুপুরে চার হাজার টাকা পাঠানো হয়েছিলো। পরে ভুল করে আবার এই নম্বরে আট হাজার ১শ’ ৬০ টাকা পাঠানো হয়েছে। টাকাটা একজন মুমূর্ষু রোগীর জন্য পাঠানো হয়েছিলো। কিন্তু ভুলে এই নম্বরে পাঠানো হয়েছে। ফেরত দিতে অনুরোধ করা হয়। ততক্ষণে একটি ক্ষুদেবার্তা ‘ক্যাশ ইন টাকা ৮১৬০.০০ টু ০১৭০১৪১৮৩৪০ সাকসেসফুল। ফি টাকা ০.০০। ব্যালেন্স টাকা ১৬,৬৭২.৬২’। রোগীর কথা শুনে সাত-পাঁচ না ভেবেই ওই ব্যক্তির দেয়া নম্বরে টাকা ফেরত পাঠিয়ে দেন জুবাইর। কিন্তু ওই ব্যক্তি আবার কল দিয়ে বলেন, ভাই টাকা কি পাঠিয়েছেন। জুবাইর হ্যাঁ জানালে ওই ব্যক্তি বলেন, আমি তো টাকা পাইনি। তাহলে সফটওয়্যারে সমস্যা হচ্ছে হয়তো। বিকাশ অফিসে কথা বলতেছি। তারাই সমাধান করে দেবে। সমাধান না হলে আমি ও আপনি কেউই টাকা পাবো না। আপনার প্রকৃত ব্যালেন্স দেখাবে না। বিকাশ থেকে কল এলে তা রিসিভ করতে অনুরোধ করেন ওই ব্যক্তি।
বিকাশ একাউন্ট চেক করে থ’ হয়ে যান জুবাইর। ব্যালেন্সে মাত্র ৫০০ টাকা দেখাচ্ছে। এরমধ্যেই +১৬২৪৭ থেকে কল আসে। শুরুতেই ‘বিকাশ হেল্প লাইনে আপনাকে স্বাগতম। ইংরেজির জন্য এক চাপুন, বাংলার জন্য দুই চাপুন।’ একপর্যায়ে ওই প্রান্ত থেকে পুরুষ কণ্ঠ ‘স্যার, আমি মেহেদি বলছি। আপনার প্রবলেম সম্পর্কে অবগত হয়েছি। এক্ষুণি সমাধান করে দিচ্ছি।’ জানতে চাওয়া হয় আশেপাশে বিকাশের এজেন্টের দোকান আছে কিনা, এমনকি ওই দোকানদারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক আছে কিনা? জুবাইরকে বলা হয় ‘স্যার, মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। কথাগুলো বুঝতে হবে তারপর পাশের এজেন্টের দোকানে যাবেন। এজেন্টদের সমস্যা হলে যেভাবে রিকভারি সেভাবেই করে দিচ্ছি। এটা তারা ফ্রি পান। কিন্তু আপনাকে তারা ফ্রি দেবে না। যে কারণে এজেন্ট বা অন্য কাউকে এ বিষয়ে কিছুই বলা যাবে না। আমরা প্রথমবার আপনাকে ফ্রি করে দিচ্ছি। আপনি একটা নম্বর লিখেন- জিরো ওয়ান এইট সিক্স নাইন এইট টু এইট সেভেন এইট ফোর। ডায়াল করে দেখেন সঠিক নম্বর নাকি ভুল নম্বর। এটা ভুল নম্বর। এটা আসলে আপনার রেজিস্ট্রেশন ফরম নম্বর। এটা পার্সোনাল নম্বর। এই নম্বরে রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে বিকাশ একাউন্ট অ্যাকটিভ করতে হবে। আপনি স্যার, লাইনে থাকা অবস্থায় দোকানে যাবেন কোনোভাবেই লাইন কাটা যাবে না। তবে ফোনটা কানের কাছেও রাখবেন না। দোকান থেকে বের হয়ে কথা বলবেন। ১৪৭৯০ এটা কোড নম্বর। ওই নম্বরে এটা সেন্ট করতে হবে। দোকানে বলবেন এটা টাকার অ্যামাউন্ট। নতুবা তারা তা সেন্ট করবে না। অবশ্য, এটা সেন্ট করলে কোনো টাকা কাটবে না বা যাবে না। তবে এজেন্টকে তা বলা যাবে না। এজেন্ট টাকা চাইবে। বলবেন শিওর হয়ে টাকা দিচ্ছি।’ যথারীতি মোবাইলের সংযোগ রেখেই নির্দেশনা অনুসারে কাজ করে জুবাইর। নিশ্চিত হয়ে এজেন্টের কাছে জানতে চায়, টাকা গিয়েছে কিনা। এজেন্ট জানায়, টাকা সেন্ট হয়েছে। খানিকটা উত্তেজিত জুবাইর ফোনে তাকে বলেন, ‘আপনি বললেন এটাতে টাকাই যাবে না। এখন গেল ক্যামনে।’ এবার ওই ব্যক্তি বলেন, ‘সরি স্যার, এটাতে টাকা চলে আসছে। নো টেনশন, একাউন্ট অ্যাকটিভ
হলে টাকা ব্রেক যাবে। এবার... এই নম্বরে ১৫০০০ সেন্ট করতে হবে। তাহলেই আপনার প্রবলেম সল্ভ হয়ে যাবে।’ ততক্ষণে জুবাইর বুঝতে পারেন তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। একইভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছেন উত্তরার একটি বায়িং হাউজে কর্মরত বরিশাল সদরের চণ্ডিপুরের সুমন হোসেন। গত ৬ই ডিসেম্বর দুপুরে উত্তরা থেকে তার ফোনে ৫শ’ টাকা সেন্ট করেন পরিচিত জন। তারপর বিকালে একটি কল এবং ক্ষুদেবার্তা। ভুলে টাকা চলে আসছে তার ফোনে ফেরত চেয়ে অনুরোধ করা হয়। জুবাইয়ের মতো তিনি প্রতারণার শিকার হন। প্রতারকরা তার কাছ থেকে ১৪৫০০ টাকা লুটে নেয়। প্রতিদিনই এরকম অভিযোগ আসছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সাইবার ক্রাইম বিভাগের পরিদর্শক মো. রফিকুল ইসলাম জানান, দেশব্যাপী এরকম অসংখ্য চক্র রয়েছে। এই চক্রের সদস্যরা কয়েকশ’ টাকা বিকাশ করার অজুহাতে গোপন ক্যামেরায় ভিডিও করে বিকাশ রেজিস্ট্রারের ছবি তুলে নেয়। পরবর্তীতে ওই রেজিস্ট্রারে থাকা গ্রাহকদের মধ্যে কয়েক জনকে টার্গেট করে। ওয়েবসাইট ব্যবহার করে লেনদেন করা টাকার চেয়ে বেশি টাকার ক্ষুদেবার্তা তৈরি করে তা টার্গেট করা ব্যক্তির ফোনে পাঠায়। ওই ক্ষুদেবার্তার প্রেরক হিসেবে ‘বিকাশ’ লেখা থাকে। তার আগেই কল দিয়ে জানানো হয়, আপনার বিকাশে টাকাটি ভুলে পাঠানো হয়েছে। তারপরই ক্ষুদেবার্তা। যাচাই করার বা চিন্তা করার অবকাশ না দিয়েই প্রতারক চক্র মানবিক ইমোশন তৈরি করে। অসুস্থ রোগীর টাকা বা এতিম শিশুর টাকা ইত্যাদি বুঝিয়ে টাকা ফেরত চাওয়া হয়। এভাবেই বিস্তার করা হয় প্রতারণার জাল। এসব বিষয়ে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সাইবার ক্রাইম বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. আলীমুজ্জামান বলেন, সাইবার ক্রাইমের বেশির ভাগ অভিযোগই ফেসবুক ও বিকাশকেন্দ্রিক। অভিযোগ পেলে গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছি আমরা। প্রায়ই প্রতারকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সারা দেশে বিকাশের মাধ্যমে প্রতারণার এরকম অনেক চক্র রয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন