সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলামকে প্রায় ৫০ লাখ টাকা ঘুষ সেধেছিল চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড। সচিব হিসেবে যোগদানের পরপরই তাঁকে উপঢৌকনের প্যাকেট পাঠায় ওই প্রতিষ্ঠানটি। প্যাকেটের মধ্যে বিদেশি মুদ্রায় এই অর্থ দেওয়া হয়।
পরে সড়ক পরিবহনসচিব বিষয়টি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানান। এ ঘটনার পর মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি লিখে বিস্তারিত বর্ণনাসহ সেই অর্থ ঢাকায় অবস্থিত চীনা দূতাবাসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
গত ১৫ অক্টোবর নজরুল ইসলাম সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে সচিব হিসেবে যোগ দেন। সচিব হিসেবে যোগদানের পরপরই এ ঘটনা ঘটে।
চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিটি ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজটি পেতে যাচ্ছিল। চীন সরকারের এই প্রকল্পে অর্থায়ন করার কথা। কত টাকায় ২২৬ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজটি করবে, তা নিয়ে দর-কষাকষি চলছিল। ঘুষ সাধার ঘটনার পর প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে দর-কষাকষির প্রক্রিয়া আটকে যায় এবং প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করে সরকার। এখন সরকার নিজের অর্থেই এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতিমধ্যে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করছে।
এই ঘুষ সাধার ঘটনাটি প্রথম জানান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামের (বিডিএফ) সভা উপলক্ষে গত সোমবার আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ওই প্রকল্পটি নিজস্ব অর্থায়নে করা হবে বলে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘যে চীনা প্রতিষ্ঠানটি কাজ করতে এসেছে, তারা ঘুষের প্রস্তাব দেয়, প্রকাশ্য ঘুষ। সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তাকে তাঁরা অর্থ দিয়েছিল, যা আমরা চীনা দূতাবাসে ফেরত দিয়েছি।’
এরপর গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যানেট ডিক্সনের সঙ্গে বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আবারও এই প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘সচিবকে অফার করেছে।’ কত টাকা—জানতে চাইলে বলেন, ‘৫০ লাখ টাকা, এমন কিছু হবে। ওই কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। অন্য কোনো কাজ পাবে না।’ ইতিমধ্যে অন্য প্রকল্পেও এই প্রতিষ্ঠানটি কাজ পেয়েছে, এখন কী হবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘দেখা যাক, কী করা যায়। সাধারণ নিয়ম হলো কালো তালিকাভুক্ত মানেই কালো তালিকাভুক্ত।’ তিনি আরও বলেন, ‘ওই প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যে কাজ পেয়ে গেছে। কাজ পাওয়ার জন্য ঘুষ দিতে চায়নি। আমার মনে হয়, খুশি করার জন্য দিয়েছে। যাতে কাজে চুরি করা যায়।’
ঘটনাটি সম্পর্কে জানতে চাইলে সড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল। সরকারের ওপর মহল বিষয়টা জানে। এখন সরকার নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ সূত্র জানায়, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ২২৬ কিলোমিটার পথ চার লেনে উন্নীত করতে গত বছরের ৯ অক্টোবর চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির সঙ্গে প্রাথমিক চুক্তি সই করে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। চীন সরকারের বিনিয়োগ (জি টু জি) পদ্ধতিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা। চায়না হারবারের সঙ্গে দর নিয়ে আলোচনার জন্য সওজের প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাছানের নেতৃত্বে ১০ জনের একটি কমিটি ছিল। এই কমিটি প্রায় এক বছর আলোচনা করে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রস্তাব করে। কিন্তু চীনা কোম্পানি ওই টাকায় কাজ করতে রাজি হয়নি। আর ঘুষ সাধার ঘটনার পরে গত নভেম্বরের দিকে আলোচনা অনেকটাই থেমে যায়।
এরপর সওজ নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দুটি প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করে। এখন সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এর বাইরে জমি অধিগ্রহণ ও সেবা সংস্থার লাইন বসানো বা সরানোর কাজে পাঁচ হাজার কোটি টাকার আলাদা প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে।
২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিং পিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে ২৬টি প্রকল্পে ২ হাজার ১৫০ কোটি ডলার দিতে সমঝোতা স্বাক্ষর হয়। ওই ২৬ প্রকল্পের একটি হলো ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্প। ওই প্রকল্পে ১৬০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা ছিল। সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি অনুসারে, চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিকে ঠিকাদারি কাজ দেওয়ার জন্য ঠিক করে দেয় চীন সরকার।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন