খুলনায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো. শাহজালালের চোখ উৎপাটনের মামলায় অভিযুক্ত খালিশপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নাসিম খানসহ সকল আসামিকে নির্দোষ দাবি করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই। একইসঙ্গে ঘটনার সঙ্গে কে বা কারা জড়িত সেটি সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
পিবিআই খুলনার পরিদর্শক মো. বাবলুর রহমান খান সোমবার মহানগর আমলী আদালত ‘গ’ অঞ্চলে ১১৪ দিন পর এ প্রতিবেদনটি দাখিল করেন। মঙ্গলবার প্রতিবেদনটি আদালতের সংশ্লিষ্ট ফাইলে নথিভুক্ত হয়। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারী মামলার পরবর্তী দিন ধার্য রয়েছে।
পিবিআই গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর আলোচিত এই মামলার তদন্তভার গ্রহণ করে।
এদিকে এ ধরনের প্রতিবেদনকে দায়সারা, দায়িত্ব অবহেলা এবং পক্ষপাতদুষ্ট বলে মন্তব্য করেছেন শাহজালালের বাবা মো. জাকির হোসেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘পুলিশের হেফাজতেই শাহজালালের চোখ তোলা হয়। এটি আমার ছেলের সাক্ষ্যতেই প্রমাণ হয়েছে। সেখানে যদি পুলিশকেই নির্দোষ বানানো হয়, তাহলে শাহজালালের চোখ উঠালো কারা?
তিনি আরও বলেন, এতোদিন ধরে তদন্ত চালিয়েও যদি পিবিআই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের সনাক্ত করতে না পারে, তাহলে তদন্তেরই বা কী প্রয়োজন ছিল!
বাদিপক্ষের আইনজীবী মোমিনুল ইসলাম এ ধরনের প্রতিবেদনকে পরস্পর বিরোধী, মনগড়া এবং সর্বোপরি পুলিশকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যেই ইচ্ছামাফিক তৈরি করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন।
তিনি বলেন, বাদিপক্ষের আইনজীবী হিসেবে তিনি এ প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন। একইসঙ্গে মামলার পরবর্তী ধার্য তারিখে আদালতে নারাজি পিটিশন দাখিল করবেন।
শাহজালালের চোখ তুলে নেয়ার ঘটনায় তার মা রেনু বেগম গত ৭ সেপ্টেম্বর খালিশপুর থানার ওসি নাসিম খানসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মহানগর হাকিম আদালতে মামলা দায়ের করেন। আদালত মামলাটি তদন্ত করে পিবিআইকে ১৮ অক্টোবরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।
এক সংবাদ সম্মেলনে শাহজালাল বলেন, ‘পুলিশ সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে গত ১৮ জুলাই আমাকে থানায় ধরে নিয়ে যায়। এরপর পরিবারের কাছে দেড় লাখ টাকা দাবি করে। কিন্তু টাকা দিতে না পারায় ওই দিন রাতে আমাকে গাড়িতে করে নির্জন স্থানে নিয়ে স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে নির্মমভাবে খুঁচিয়ে দুটি চোখ তুলে নেয় পুলিশ।’
প্রতিবেদনের চুম্বক অংশ
তদন্ত প্রতিবেদনের ১৫ নম্বর কলামের মতামত অংশে পিবিআই খুলনার পরিদর্শক মো. বাবলুর রহমান খান উল্লেখ করেন, তদন্তকালে তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন, খসড়া মানচিত্র, সূচিপত্র ও ঘটনাস্থলের ছবি উত্তোলন, থানার জিডি, সিসি, হাজতী রেজিস্ট্রার, আসামির চালান কপি, কোর্ট হাজতী রেজিস্ট্রার ও জেলখানার আসামি রেজিস্ট্রার এবং খালিশপুর থানা ও খালিশপুর ক্লিনিকের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করেছেন।
এছাড়া বাদি ও ভিকটিমসহ আটজন, নিরপেক্ষ ২৫ জন এবং ১৮ জুলাই খালিশপুর থানা হাজতে থাকা দু’জনসহ মোট ৩৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন।
মামলার সার্বিক তদন্ত এবং ঘটনার পারিপার্শ্বিকতায় পিবিআই খুলনার পরিদর্শক মতামত দিয়েছেন, মামলার প্রধান আসামি খালিশপুর থানার ওসি মো. নাসিম খানের বিরুদ্ধে পেনাল কোডের সংশ্লিষ্ট ধারাসহ নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন-২০১৩’র ১৩/১৫ ধারার অভিযোগের স্বপক্ষে কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
একইভাবে আসামি এএসআই রাসেল, এসআই তাপষ কুমার পাল, এসআই মো. মোরসেলিম মোল্লা, এসআই মো. মিজানুর রহমান, কনস্টেবল আল মামুন, আনসার সিপাহী মো. আফসার আলী, ল্যান্স নায়েক আবুল হাসেম, আনসার নায়েক রেজাউল হক, এসআই মো. নূর ইসলাম এসআই সৈয়দ সাহেব আলী, সুমা আক্তার এবং মো. রাসেলের বিরুদ্ধেও অভিযোগের স্বপক্ষে কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
একই সঙ্গে প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা বাবলুর রহমান খান আরও উল্লেখ করেন, ‘তবে তদন্তকালে জানা যায়, ভিকটিম শাহজালাল ওরফে শাহ জামাল ওরফে শাহ গত ১৮ জুলাই রাত আনুমানিক সাড়ে ১১টার সময় খালিশপুর থানাধীন গোয়ালখালি বাসস্ট্যান্ডে ছিনতাইকালে হাতেনাতে ধৃত হয়ে বিক্ষুব্ধ জনগণ কর্তৃক মারপিটের শিকার হন। এতে তার দু’ চোখ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে চোখ দু’টি নষ্ট হয়ে যায় যা পেনাল কোডের ১৪৩/৩২৩//৩২৬ ধারার অপরাধ। তদন্তকালে এ নৃশংস ঘটনায় কে বা কারা জড়িত তা সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।’
বাদি ও বাদিপক্ষের আইনজীবীর প্রতিক্রিয়া এবং প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যানের বিষয়ে কথা বলার জন্য তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই খুলনার পরিদর্শক মো. বাবলুর রহমান খানের সেলফোনে যোগাযোগ করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। এর আগে একাধিকবার রিং হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
শাহজালালের মায়ের মামলায় ঘটনার বর্ণনা
এর আগে আদালতে দাখিলকৃত শাহজালালের মায়ের এজাহারে উল্লেখ করা হয়, গত বছরের ১৮ জুলাই শাহজালাল নগরীর নয়াবাটি রেললাইন বস্তি কলোনীর শ্বশুর বাড়ি থেকে রাত ৮টায় শিশুকন্যার দুধ কেনার জন্য বাসার পার্শ্ববর্তী দোকানে যায়। এ সময় খালিশপুর থানার ওসি নাসিম খানের নির্দেশে তাকে থানায় ডেকে নেয়া হয়।
পরিবারের সদস্যরা থানায় গেলে ওসি তাকে ছাড়ানোর জন্য দেড় লাখ টাকা দাবি করেন। দাবিকৃত টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় রাত সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশ কর্মকর্তারা শাহজালালকে পুলিশের গাড়িতে করে বাইরে নিয়ে যায়।
পরদিন ১৯ জুলাই খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে শাহজালালকে দু’টি চোখ উপড়ানো অবস্থায় দেখতে পান।
এ সময় শাহজালাল জানান, পুলিশ কর্মকর্তারা হত্যার উদ্দেশ্যে তাকে গাড়িতে করে গোয়ালখালি হয়ে বিশ্ব রোডের (খুলনা বাইপাস সড়ক) নির্জন স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে তার হাত-পা চেপে ধরে এবং মুখের মধ্যে গামছা ঢুকিয়ে স্ক্রু ডাইভ্রার দিয়ে দু’টি চোখ উপড়ে ফেলে।
সর্বশেষ গত ৬ জানুয়ারি খুলনা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে করে শাহজালালের পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, মামলা তুলে নেয়ার জন্য খালিশপুর থানার ওসি নাসিম খানসহ অন্যান্য আসামিরা তাদেরকে ৭ লাখ টাকা দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। ওই প্রস্তাব গ্রহণ না করায় তাদের হুমকি দেয়া হচ্ছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন