বছরের প্রথম দিনেই এই মর্মে খবর চাউর হয় যে, নতুন কয়েকজনকে মন্ত্রী করা হচ্ছে। পরদিন বঙ্গভবনে তিনজন পূর্ণমন্ত্রী এবং একজন প্রতিমন্ত্রীর শপথ হয়। তারমধ্যে একজন ইতিপূর্বে প্রতিমন্ত্রী ছিলেন, তাকে পূর্ণমন্ত্রী করা হয়েছে। বাকিরা একেবারেই নতুন। ৩ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকের পর সচিবালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম মন্ত্রিসভার দপ্তর বণ্টন ও পুনর্বণ্টনের তথ্য সাংবাদিকদের জানান। পরে এ সম্পর্কে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারি করে। নতুন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের শপথের পর থেকেই মন্ত্রিসভায় রদবদল বিষয়ে নানা গুঞ্জন চলে আসছিল। সেই গুঞ্জনই পরে বাস্তবে রূপ নিল। নতুন মন্ত্রীদের দফতর বণ্টনের পাশাপাশি আরও কয়েকজন মন্ত্রীর দফতর পুনঃবন্টন করা হয়েছে।
নবনিযুক্ত তিন মন্ত্রী ও এক প্রতিমন্ত্রীর মধ্যে লক্ষীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের এমপি এ কে এম শাহজাহান কামালকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ও খুলনা-৫ আসনের এমপি নারায়ণ চন্দ্র চন্দকে একই মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি মোস্তাফা জব্বারকে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী, রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও রাজবাড়ী-১ আসনের এমপি কাজী কেরামত আলীকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে। এরসঙ্গে দফতর বদল হয়েছে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, রাশেদ খান মেনন ও তারানা হালিমের।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির পর ১২ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠান হয়। ওই দিন ৪৯ সদস্যের মন্ত্রিসভা গঠন করে এ সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছিল; যার মধ্যে ২৯ জন মন্ত্রী, ১৭ জন প্রতিমন্ত্রী ও দুইজন উপমন্ত্রী। এর দেড় মাসের মাথায় এ এইচ মাহমুদ আলী মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম হিরু পান প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব। অন্যদিকে ইসলাম ও হজ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য অক্টোবরে মন্ত্রীত্ব খোয়ান আবদুল লতিফ সিদ্দিকী।
এটিকে বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভার শেষ ও বড় রদবদল বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, এ বছরের শেষ দিকেই নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। তবে এই রদবদলে নতুন করে যারা মন্ত্রিপরিষদে স্থান পাবেন বলে এতোদিন আশা করছিলেন তাদের কপাল খুলেনি। অন্যদিকে যাদের বাদ পড়ার কথা ছিল তাদের গায়ে আঁচড়ই লাগেনি। বিশেষ করে মন্ত্রিসভায় এমন কয়েকজন আছেন যারা বহাল তবিয়তে থাকাটাকে ভালো চোখে দেখছে না সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আওয়ামী লীগের কর্মীরাই মনে করছেন, এদের বোঝা নির্বাচনের আগে না নেওয়াই ভালো ছিল। তবে সরকারের নীতি নির্ধারকরা বলছেন অন্য কথা। তাঁদের মতে, নির্বাচনের আগে দুর্নীতি বা অদক্ষতার অভিযোগে কাউকে বাদ দিলে এসবের বদনাম সরকারের ঘাড়েই এসে পড়বে। এজন্যই কৌশলগত কারণে বিতর্কিতদের বাদ দেওয়া হয়নি। যে কারণেই হোক মন্ত্রিসভার রদবদল মানুষকে আশান্বিত করতে পারেনি, এমনকি আওয়ামী লীগ সমর্থকদেরও নয়। বরং মন্ত্রিপরিষদ নিয়ে অসন্তোষ যেন আরও বেড়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
দফতর বদল হওয়া মন্ত্রীদের প্রতিক্রিয়া
দফতর পরিবর্তন হওয়ার পর সবচে’ বেশি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তারানা হালিম। ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে তারানা হালিমকে তথ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। তথ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়ার পর তারানা হালিম বলেন ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের কাজ শেষ করে এনেছি। স্যাটেলাইট বিষয়ে মানুষের কোনও ধারণা ছিল না। ‘আমাকে সরিয়ে দেওয়াটা মানুষ হিসেবে একটু লাগে। আমি তো ফেরেশতা নই, অন্য কিছুও নই; মানুষ। রক্তে-মাংসে গড়া।’ তিনি আরো বলেন ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটসহ আমার হাতে সম্পন্ন করা জিনিসগুলো যখন প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্য কেউ উদ্বোধন করবেন, সেটি যখন আমি দেখব, আমার লাগাটা কি স্বাভাবিক নয়?’
বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। মন্ত্রণালয় পরিবর্তন করে তাকে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করা হয়েছে। দফতর পরিবর্তনের পর গণমাধ্যমে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলতে পারবেন কেন, কিসের জন্য তিনি পরিবর্তন করেছেন। এ বিষয়ে আমার কোনও ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়া নেই। আমি কুম্ভ রাশির জাতক, কাজের লোক। বদলের কারণ আমি বলতে পারব না। উনি (প্রধানমন্ত্রী) হর্তা কর্তা বিধাতা, উনি সব নির্ধারণ করেন।’
এদিকে বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে রাশেদ খান মেননকে দেয়া হয়েছে সমাজকল্যাণমন্ত্রীর দায়িত্ব। দফতর পরিবর্তনের পর মেননও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আকাশ থেকে তিনি মাটিতে নামলেন।’ রদবদলের ঘোষণা আসার পর বিকালে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এই প্রতিক্রিয়া জানান।
যেসব যুক্তি
বাংলাদেশ বিমান এবং সিভিল এভিয়েশনের ব্যবস্থাপনা নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে রাশেদ খান মেননের ব্যাপারে অনেক দিন ধরে অসন্তোষ ছিল। ২০১৬ সালের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাঙ্গেরি সফরে যাওয়ার সময় বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সেই বিমান জরুরি অবতরণ করাতে হয়েছিল। এ নিয়ে সরকারের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যেও ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। এখন মেননকে সরিয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়ার পিছনে এসব বিষয় অন্যতম কারণ হয়ে থাকতে পারে বলে আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করছেন।
আওয়ামী লীগের আরেক শরীক জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাঁর ব্যাপারেও আওয়ামী লীগের ভেতরে সমালোচনা ছিল। আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকে বলেছেন, হাওর অঞ্চলে বাঁধ ভেঙ্গে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়ার ক্ষেত্রে পানিসম্পদ মন্ত্রী হিসাবে তিনি যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারেননি বলেই তারা মনে করেন।
এখন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে জাতীয় পার্টির আরেক অংশের নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে। তিনি এতদিন বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। সেই মন্ত্রণালয়ে তাঁর কাজ নিয়েও আওয়ামী লীগের ভিতরে সমালোচনা ছিল বলে দলটির নেতাদের অনেকে বলছেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের আরেক শরিক জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে বহাল থাকলেও সেখানে তাঁর একক ক্ষমতা কিছুটা খর্ব হবে বলে মনে হচ্ছে তারানা হালিমকে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দেয়ায়।
আওয়ামী লীগপন্থী সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। সেই প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের বিশ্বস্ত একজনকে তথ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে বসানো হলো বলে দলের মধ্যেই ধারণা করা হচ্ছে। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের শরিক দলগুলোর কয়েকজন নেতাকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। এনিয়ে আওয়ামী লীগের ভিতরে ক্ষোভ ছিল এবং ওই মন্ত্রীদের কাজ নিয়ে বিভিন্ন সময় দলটির ভিতরে সমালোচনাও হয়েছে।
সম্প্রতি বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং দুর্নীতি নিয়ে মন্তব্য করায় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে নিয়েও আওয়ামী লীগের ভিতরে সমালোচনা হয় বলে দলটির নেতারা বলছেন। নতুন প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলীকে তার মন্ত্রণালয়ে দেয়ায় নুরুল ইসলাম নাহিদের ক্ষমতা কিছুটা খর্ব হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
জোট মন্ত্রীদের হঠাৎ কেন দপ্তর বদল
এবারের মন্ত্রিসভার রদবদল সবচেয়ে বেশি টার্গেট হয়েছেন মহাজোটের শরিক দলের মন্ত্রীরা। সরকারের শেষ সময়ে এসে হঠাৎ করে জোটমন্ত্রীদের দপ্তর বদলের এ ঘটনা রাজনীতিতে নানা প্রশ্ন ও আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক নেতারাও মন্ত্রিসভায় আকস্মিক এমন রদবদলে বিস্মিত। এটা তাদের অনেকেরই ধারণার বাইরে ছিল।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় পার্টির (এরশাদ) প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অন্যতম তিন শরিক দলের প্রভাবশালী নেতা। এ কারণে এই রদবদলকে রাজনৈতিকভাবে সরকারের শেষ বছরের চমকের পাশাপাশি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখছেন আওয়ামী লীগের কেউ কেউ। মহাজোটের আরেক শরিক জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনুর তথ্য মন্ত্রণালয়েও একজন প্রতিমন্ত্রী দিয়েছে সরকার।
বাম দলগুলোর সঙ্গ ছাড়ছে সরকার?
জাতীয় নির্বাচনের বাকি আর একবছর সময়ও নেই। এমন প্রেক্ষাপটেই হঠাৎ করে মন্ত্রিসভায় বড় ধরণের রদবদল করা হলো। এই রদবদলকে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা তাদের নির্বাচনী কৌশলের অংশ হিসাবেই বর্ণনা করছেন।
তবে বিশ্লেষকরা এই রদবদলকে শরিক দল বিশেষ করে বাম দলগুলোর সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্কের অবনতি হিসেবেই দেখছেন। তাদের মতে, নির্বাচনের আগে বামপন্থি দলগুলোর সাথে দূরত্ব তৈরি করে ইসলামি দলগুলো ও ইসলামপ্রিয় মানুষের আস্থা অর্জনে চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। রদবদলের প্রভাব বেশি পড়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক দলগুলোর নেতাদের উপর। শরিক দলগুলো যেমন জাতীয় পার্টি ও বামদলগুলো থেকে যারা মন্ত্রিসভায় রয়েছেন, তাদেরই অনেকের দায়িত্ব পরিবর্তন ও খর্ব করা হয়েছে।
বামরা হতাশ ও অসন্তুষ্ট
বিএনপিকে মোকাবেলা করে ক্ষমতা ধরে রাখার স্বার্থে বাম দলগুলোর সাথে জোটবদ্ধ হলেও তাদেরকে কখনোই বিশ্বাস করতে পারেনি আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনে বাম দলগুলোর অবদান ও হত্যার পর জাসদের ইনুসহ বামদলগুলোর উল্লাস শেখ হাসিনা কখনোই ভুলে যাননি। তাই তাদেরকে জরুরি দরকারের সময় কাজে লাগালেও প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে ছুঁড়ে ফেলতেও দেরি করেন না তিনি।
রাশেদ খান মেনন মন্ত্রণালয়ে থাকাবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর বিমানে ত্রুটিকে তাই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। দলটির নেতারা মনে করেন বামদলগুলো এখন মুখে যতই বঙ্গবন্ধুর গুণকীর্তন করুকনা কেনো তারা বিশ্বস্ত নয়। সুযোগ পেলেই ক্ষতি করতে একটুও দেরি করবে না।
এদিকে, সরকারি দলের এমন আচরণে বাম দলগুলোও পড়েছে বিপাকে। তারা সরকারের সাথে মিশে থেকে কোনোভাবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে বহুদিন ধরে। কিন্তু এখন যদি সরকারি দল তাদেরকে ছেড়ে দেয় তাহলে অস্তিত্ব ধরে রাখাই তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। খালেদা জিয়াকে আক্রমণ করে অনবরত বক্তব্য এবং বঙ্গবন্ধুর গুণকীর্তনের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে খুশি করার যেই প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন সেই প্রচেষ্টাও হয়তো বিফলে যাচ্ছে।
মোটকথা অনেক কাঙ্খিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে কঠিন সংকটেই পড়তে যাচ্ছে বাম দলগুলো। আগের ন্যায় আওয়ামী লীগে সওয়ার হওয়ার সুযোগ হয়তো তাদের এবার হবে না। আওয়ামী লীগ নিজেদের স্বার্থেই এমনটি আর করবে না। কারণ এখন তাদের ভোটের প্রয়োজন। ইসলামি দলগুলোর কাছেই ভোট। কিন্তু একই সঙ্গে বাম এবং ইসলামী দলগুলোকে খুশি রাখা যাবে না। আগামী নির্বাচনের আগে অবশ্যই এই অবস্থার পরিবর্তন তাদেরকে করতে হবে। সেটিই আওয়ামী লীগ এখন করছে।
দলীয় সভাপতি রাশেদ খান মেননের মন্ত্রণালয় বদল নিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টিতে কিছুটা হতাশা দেখা দিয়েছে। সিংহভাগ নেতাকর্মীই মনে করেন, মন্ত্রিসভায় রদবদল একটি স্বাভাবিক বিষয়। তবে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ শরিক দলের শীর্ষ নেতার মন্ত্রণালয় বদল প্রত্যাশিত নয়। ওয়ার্কার্স পার্টির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও পলিটব্যুরোর সদস্য আনিসুর রহমান মল্লিক এ প্রসঙ্গে বলেছেন, এই পরিবর্তন বর্তমান মন্ত্রিসভা গঠনের দেড়-দুই বছরের মাথায় হলেও মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনের বছরেই যেভাবে রাশেদ খান মেননের দপ্তর বদলে দেওয়া হলো, তা গ্রহণযোগ্য নয়।
তারানা হালিমকে সরানোর নেপথ্য কারণ কী?
তারানা হালিমকে সরিয়ে দেয়ায় সরকারের ভিতরে বাইরে, নানা মহলে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বলা হচ্ছে, সরকারি দলের নেপথ্য ক্ষমতাবান এক ব্যক্তি, দুই একজন নেতা, প্রতিমন্ত্রী মিলেই আঁটঘাট বেঁধে নেমেছিলেন তারানাকে সরাতে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দপ্তর বন্টনের আগেও ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম জানতেন না তাকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। কয়েকদিন আগে তারানা হালিমকে সেই ক্ষমতাবান ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু তারানা হালিম তার সিদ্ধান্তে ছিলেন অনড়। দেখা করার প্রশ্নই উঠে না-বলেছিলেন। সেই ক্ষমতাবান ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করে আপোস না করায় তাকে সরে যেতে হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
বিতর্কিত মন্ত্রীরা বহাল তবিয়তে
সরকার তার মেয়াদের শেষ বছরে এসে মন্ত্রিসভার যে রদবদল করেছে তাতে বিতর্কিত কোনো মন্ত্রীই বাদ পড়েননি। খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের একই মন্ত্রণালয়ে বহাল থাকাটা এই রদবদলের বড় চমক। গম কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে নিয়ন্ত্রণহীন চালের বাজারে মানুষের নাভিশ্বাস। একান্ত আলাপে খোদ সরকারেরই অনেক মন্ত্রী-এমপি খাদ্যমন্ত্রীর অদক্ষতার কথা স্বীকার করেন। চালের দাম সরকারের সমালোচনার এখন প্রধান ইস্যু। অথচ রদবদলে বহাল রইলেন অ্যাডভোকেট কামরুল।
ভূমিমন্ত্রীর পরিবারকে নিয়ে শুরু থেকেই বিব্রত সরকার। সর্বশেষ সাংবাদিকদের সঙ্গে অশোভন আচারণের কারণে জেলে যান ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফের ছেলে। এর আগেও এলাকায় কয়েক দফায় এমনটা ঘটান মন্ত্রীর পুত্র। কিন্তু মন্ত্রিসভার রদবদলে তাঁর গায়েও আঁচড় লাগেনি।
নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান মন্ত্রণালয়ের চেয়ে শ্রমিক-কর্মচারীদের নিয়েই ব্যস্ত। তাছাড়া নৌ মন্ত্রণালয়ের কেনাকাটাসহ বিভিন্ন কর্মকা-ে অনেক দুর্নীতির কথাও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে ইতিপূর্বে। সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে তিনি নতুন করে বিতর্কিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই তাকে ভিন্ন নামে আখ্যায়িত করে থাকেন। কিন্তু তিনিও বহাল।
হজ কেলেঙ্কারিতে হ্যাটট্রিক করেছেন ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান। তাঁর বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ করেছেন খোদ সচিব ও মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য কর্মকর্তারা। কিন্তু রদবদলে তিনিও অক্ষত রয়ে গেছেন। অদক্ষতার অভিযোগ আছে, ইমেজ সংকটে থাকা ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার বিরুদ্ধেও। ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আরিফ খান জয়ের মন্ত্রণালয়ে কোনো কার্যক্রমই নেই। বরং বিতর্কিত কাজেই তিনি শিরোনাম হন। উপমন্ত্রী হিসেবে তিনিও অপরিবর্তিত।
অনেকদিন ধরেই বিতর্কের শীর্ষে আছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বয়সের ভারে ন্যুজ হয়ে প্রায়ই তিনি বিতর্কিত মন্তব্য করে হাস্যরসের খোরাক হন। তাঁর প্রস্থানের বিষয়টি বিভিন্ন ভাবে আলোচনা হলেও মন্ত্রিসভার রদবদলে তিনি রয়েই গেলেন। ব্যাংকিং খাতে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, এই পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রণালয়ের একটি পরিবর্তন সাধারণ মানুষ কামনা করেছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে তার নানা রকমের উল্টাপাল্টা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে গোটা শিক্ষাখাত অত্যন্ত বেহাল দশায় পড়েছে। তার উপর প্রশ্নফাঁস কেলেংকারি এবং নিজের নানান বিতর্কিত বক্তব্য সরকারকেই বিব্রতকর অবস্থায় ফেলছে। দুর্নীতির অভিযোগ তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে তার বিরুদ্ধে পদত্যাগের দাবি উঠছিলো বেশ কিছুদিন ধরেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নতুন একজন প্রতিমন্ত্রী দেয়ায় নুরুল ইসলাম নাহিদের ক্ষমতা কিছুটা হলেও খর্ব হবে বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। তবে নুরুল ইসলাম নাহিদকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পুরো সরিয়ে দেয়াটাই এ মুহূর্তে জরুরি ছিল বলে সংশ্লিষ্ট সবাই মনে করছেন।
এবারও মন্ত্রিসভায় নেই তারা?
মন্ত্রিসভার রদবদল হলেই তাঁদের নাম ঘুরে ফিরে আসে, কিন্তু তারপরও তাঁরা উপেক্ষিত। কেন? বছরের শুরুতেই মন্ত্রিসভার রদবদলের পর সেই নামগুলো আলোচনায় উঠে এসেছে। তাঁরা এবারও কেন অন্তর্ভুক্ত হলেন না মন্ত্রিসভায় সে প্রসঙ্গে চায়ের কাপে ঝড়ও উঠেছে। তবে, কারও কাছে উত্তর নেই।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের প্রভাবশালী সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। ১৯৯৬-২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু ২০০৮ সাল থেকে সর্বশেষ রদবদল পর্যন্ত মন্ত্রীত্ব শেখ সেলিমের জন্য অধরাই রয়ে গেল। আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ অনেকে মনে করেন, ওয়ান ইলেভেনে গ্রেপ্তারের পর তাঁর দেওয়া জবানবন্দির কারণেই মন্ত্রীত্ব থেকে দূরে আছেন তিনি। কিন্তু এরকম জবানবন্দি অনেকেই দিয়েছিলেন, যাঁরা এখন মন্ত্রী। তাছাড়া ওয়ান ইলেভেনে যাঁরা শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন তাঁরাও মন্ত্রীত্ব পেয়েছেন। কাজেই ‘জবানবন্দি’ মন্ত্রীত্বের পথে আদৌ বাধা কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আওয়ামী লীগের একটি সূত্রের মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর আত্মীয় কাউকে মন্ত্রী না করার নীতিতে অটল থাকতে চান। আর সেই কারণেই হয়তো শেখ সেলিম মন্ত্রীত্ব পাচ্ছেন না।
আওয়ামী লীগের অরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু। ৯৬ সালে আইন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কার্যক্রমও তাঁর হাতেই শুরু হয়েছিল। ওয়ান ইলেভেনের সময় তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম কৌসুলী ছিলেন। তারপরও তাঁর মন্ত্রিসভায় না থাকাটা একটা বিস্ময়। গত নয় বছরে প্রতিটি রদবদলেই তাঁর নাম এসেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর বঙ্গভবন যাওয়া হয়নি।
পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন সৈয়দ আবুল হোসেন। কানাডার আদালত যখন রায় দেয় পদ্মা সেতুতে কোনো দুর্নীতি হয়নি তখন থেকেই তাঁর ফিরে আসার জল্পনা-কল্পনা হতে থাকে। এমনকি তিনি সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয় অর্থাৎ সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ফিরে পাবেন বলেও কথা উঠেছিল ইতিপূর্বে। কিন্তু অবশেষে এসব কল্পনাই থেকে গেলো। মন্ত্রিসভা রদবদলের পরদিনই মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার এনবিআর’র চেয়ারম্যান হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের পর সৈয়দ আবুল হোসেন প্রসঙ্গ আবার আলোচনায় এসেছে। বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করে তখন সৈয়দ আবুল হোসেন ওই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন, আর সেতু বিভাগের সচিব ছিলেন মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। দুর্নীতি দমন কমিশন মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করে হাতকড়াও পরিয়েছিল। পরবর্তীতে মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া চাকরিতে পুনর্বহাল হন। শিল্প সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অবসরের সময় তাঁকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও দেওয়া হয়। গত বছর জুনে তিনি অবসরে গিয়েছিলেন। অনেকটা বাড়ি থেকে ডেকে এনে তাকে এখন এনবিআর’র চেয়ারম্যান করা হলো।
অবশ্য সৈয়দ আবুল হোসেনের ঘনিষ্ঠরা দুঃখ ভুলে যাওয়ার সুরে বলছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়েই তিনি ব্যস্ত আছেন। মন্ত্রী হতে তিনি আগ্রহী নন। মন্ত্রিসভার যে কোনও রদবদলে স্থান পাবেন বলে দীর্ঘদিন ধরে আশা করে ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, ডা. দীপু মনিও।
(সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ৮ জানুয়ারি, ২০১৮ প্রকাশিত)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন