সরকারি, বেসরকারি কিংবা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের ভুয়া ডক্টরেট (পিএইচডি) ডিগ্রি ব্যবহার করে বাড়তি সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ পুরনো। ভুয়া ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে অনেকেই পদোন্নতি নিচ্ছেন। পাচ্ছেন বাড়তি আর্থিক সুবিধা। এতে সরকারি প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত অর্থ গচ্চা দিচ্ছে রাষ্ট্র।
অন্যদিকে ডক্টরেট ডিগ্রির জমজমাট ব্যবসা করছে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিষ্ঠানটির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, বছর দুয়েক আগে ভুয়া পিএইচডি জমা দেওয়ার দায়ে প্রথম সারির একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রোভিসিকে অপসারণ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। একটি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের পিএইচডি ডিগ্রি ভুয়া চিহ্নিত হওয়ার পর তিনি এখন আর নামের আগে ডিগ্রি ব্যবহার করেন না। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কাজ করছে।
জানা গেছে, অননুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে ভুয়া ডক্টরেট ডিগ্রি সনদ নিয়েছেন অনেকে। এর মধ্যে আমেরিকা ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি পাঁচ হাজারের বেশি পিএইচডি ডিগ্রি দিয়েছে। আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি দিচ্ছে। সম্প্রতি ডিআইএর কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য চেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তদন্তের স্বার্থে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তা নেবে দুদকের এ সংক্রান্ত অনুসন্ধান টিম। শুধু ডিগ্রিধারী নয়, যারা এ সনদ বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত, তারাও আইনের আওতায় আসবে। ডিআইএর বিভিন্ন সময়ের অনুসন্ধানে সরকারি, বেসরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে ভুয়া সনদে চাকরি করছেন, এমন সংখ্যা ছিল ৫ হাজারের বেশি। কিছু প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষার নামে চৌর্যবৃত্তি চলছে।
এ প্রসঙ্গে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার আমাদের সময়কে বলেন, জাল সনদ নিয়ে আমরা বেশ উদ্বেগের মধ্যে আছি। তদন্ত করতে গিয়ে প্রচুর জাল সনদ পাচ্ছি। সেসবের মধ্যে পিএইচডি-ডক্টরেট ডিগ্রিও পাওয়া গেছে। আমরা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না। ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করি। তিনি বলেন, ভুয়া ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে অনেকেই পদোন্নতি, আর্থিক সুযোগ নিচ্ছেন। এতে সরকারের অতিরিক্ত অর্থ খরচ হচ্ছে। দুদকের অনুসন্ধানে আমাদেরও সহযোগিতা থাকবে।
এদিকে ভুয়া ডক্টরেট ডিগ্রির সনদধারী ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে নোটিশ দিতে দিতে হয়রান হয়ে গেছি। ইউজিসির আইনে ভুয়া পিএইচডি ধরার কোনো সুযোগ নেই। এটা ফৌজদারি অপরাধ। কারণ এ সনদ দেওয়া ও নেওয়ার ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেন হয়। ইউজিসিতে জাল সনদ ধরার উইং নেই, লোকবলও নেই। তিনি বলেন, ভুয়া পিএইচডি সনদ নিয়ে অনেকেই সরকারি ও বেসরকারি দপ্তরে কাজ করে পদোন্নতি ও বাড়তি আর্থিক সুবিধা নিয়ে থাকেন। সবাইকে ধরা উচিত। আমরা তো সার্কুলার দিয়েছি, কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বিদেশি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে আমাদের দেশে শাখা অফিস করে পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়ার অনুমোদন দেয়নি সরকার। কাজেই এ ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকে যারা পিএইচডি ডিগ্রি নিচ্ছেন, তার কোনো বৈধতা নেই।
যতযত্র ডক্টরেট ডিগ্রির সনদ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, একসময় পিএইচডিধারীদের দেখতে ভিড় জমাত লোকজন। এখন তাকায়ও না। কারণ মান কমে যাওয়া। যত্রতত্র ডিগ্রি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক শুধু বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিগত মুনাফার উদ্দেশ্যে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পিএইচডির তত্ত্বাবধায়ক হচ্ছেন। পরবর্তীতে তারা এদের কাছ থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেনÑ এমন অভিযোগ আছে। এটি মোটেও সুখকর নয়।
উল্লেখ্য, জাল সনদ ধরতে দুদকের কয়েকটি টিম কাজ করছে। সেখানে যত ধরনের জাল সনদ পাওয়া যাবে, সব তদন্ত করে ধরা হবে। যত্রতত্র ভুয়া পিএইডডি ডিগ্রি নিয়ে সরকারের সর্ব্বোচ পর্যায়েও কাজ চলছে। প্রকৌশলী, ডাক্তার, প্রশাসনের কর্মকর্তা, শিক্ষক, এমনকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিরা এই তদন্তের আওতায় রয়েছে। বিসিএসআইআরের একজন মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির ডক্টরেট সনদ নিয়ে দুদকের কাছে অভিযোগ করেছেন ওই অফিসের কয়েকজন। তেমনই অন্য কোথাও সনদ নিয়ে যে কেউ ইচ্ছা করলে লিখিত আকারে দুদকে অভিযোগও করতে পারবে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর এবং পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের অভিযোগগুলো আমলে নিয়েও অনুসন্ধান করবে দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানটি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন