রাজধানী ঢাকার প্রতিটা দিন যেমন তুলনাবিহীন কোলাহলে পূর্ণ, তেমনি রাতগুলো ততটাই নির্জন। কেউ জেগে না থাকার সেই সময়টাতেও যারা জেগে থাকেন তারা হলেন আপনার-আমার নিরাপত্তাকর্মী। আপনি যাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন সে জন্য রাতের ঘুম ত্যাগ করেছেন এই পেশাজীবী মানুষগুলো। কিন্তু এর বিনিময়ে কী পাচ্ছেন তারা? যারা আপনাকে সারা দিনের দৌড়ঝাঁপ শেষে রাতে শান্তিতে ঘুমানোর নিশ্চয়তা দেয়; নিরাপত্তা দেয় এটিএম বুথে, ব্যাংকে, মার্কেটে, দেশের নানান জায়গায়, নিরাপত্তার স্বার্থে যাদের নিয়োগ দিচ্ছেন, সেই মানুষগুলোর কী অবস্থা খোঁজ নিয়েছেন কখনো?
আবার প্রশ্নটা এভাবেও করা যেতে পারে। যে নিরাপত্তা প্রহরী আপনাকে নিরাপত্তা দিতে দিনরাত কাজ করছেন, তার সামাজিক নিরাপত্তার দায়িত্বটা কে নিচ্ছে?
শুনলে অবাক হবেন ঢাকা শহরে কাজ করছে যেসব নিরাপত্তাকর্মী তাদের মাসিক গড় বেতন সাত হাজার টাকার কিছু বেশি। অনেক জায়গায় এর চেয়েও কম বেতনে চাকরি করতে হয় তাদের। ঢাকার প্রাণকেন্দ্র মতিঝিল থেকে শুরু করে ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, বারিধারার মতন বনেদি এলাকাতে নিরাপত্তাকর্মীদের বেতন এ রকম একটি সংখ্যার আশপাশে ঘোরাফেরা করে। কাজের শ্রমঘণ্টা বেশি, বেতন কম- এই একই চিত্র সব জায়গায়। সাপ্তাহিক ছুটি, অসুস্থতার ছুটি নেই। অন্য কোনো ভাতাও নেই। বলা যায় এ শহরে আপনারই চোখের সামনে শোষিত বঞ্চিত ও অবহেলিত হচ্ছে এই পেশার লোকজন। আধুনিক ক্রীতদাস বললেও হয়তো কম বলা হবে না।
রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করছেন মো. মজিবর। শুরুর দিকে সাড়ে ছয় হাজার টাকা বেতন পেতেন। কিছুদিন আগে সেটা বেড়ে হয়েছে আট হাজার টাকা। অতিরিক্ত আট ঘণ্টা ডিউটি করলে পান আরো ১১৫ টাকা। সিলেটের মৌলভীবাজার থেকে ঢাকায় এসেছেন বছর চারেক হয়ে গেলো। গত চার বছরে দেশের নানা উত্থানপতন হলেও কোনো পরিবর্তন আসেনি মুজিবরের জীবনে। মুজিবর বলেন, 'ঢাকায় আসছি চার বছর। নাইটগার্ডের কাজ করি। যেই বেতন পাই তা দিয়া হয় না। খাওয়ার বিল ২২০০ টাকা। থাকা ৫০০ টাকা। যা থাকে পুরাটা বাড়িতে পাঠায়া দেই। ছেলেটা কলেজে পড়ে। ওর পড়ালেখার খরচ আমার দিতে হয় না, ওর চাচা দেয়। এইদিক দিয়ে বাঁচছি, কারণ খরচ আমার দিতে হইলে ওর পড়ালেখা বন্ধ করে দিতে হইতো।'
একই কথা বললেন রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার একজন নিরাপত্তাকর্মী মো. জাহিদ হাসান। জাহিদ বলেন, ‘গার্ডের চাকরিতে বেতন অনেক কম। কিন্তু কী করার আছে! সাত হাজার টাকা পাই। বাড়তি ডিউটি করলেও ওভারটাইমের সিস্টেম নাই। থাকলে ভাল হইত। না পারতে বিকালের দিকে সিগারেট বেচি আর রাইতে নাইটগার্ডের ডিউটি করি।’
বাসাবাড়িতে নিয়োজিত নিরাপত্তকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে তাদেরও একই রকম অবস্থা। শুধু বেতন কম তাই নয়, ছুটি নেবার সুযোগ নেই, বাড়তি খাটলেও নেই ওভারটাইমের সুবিধা। বেতন বাড়াবার কোনো নিয়ম-কানুনের কোনো বালাই নেই। আর অসুস্থ হলে চিকিৎসার সুবিধা তো অলীক স্বপ্নের মতন। বেতনও নাকি অনেক মাসে সময়মতো পাওয়া যায় না এমন অভিযোগ বাসাবাড়ির নিরাপত্তাকর্মীদের। সেই সাথে রয়েছে যখন তখন চাকরি খোয়াবার ভয়।
শান্তিনগরের একটি অ্যাপার্টমেন্ট বাড়িতে কর্মরত নিরাপত্তাকর্মী সোহেল আমিন জানান, ‘কোনো বাসায় চুরি, ডাকাতি হলে সবার আগে আমারে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে। থানা পুলিশ হলে সবার আগে আমারে ডাকে। মনে হয় আমিই যেন সব চুরি-ডাকাতি করিছি। তবু চাকরিটা করি, আর কোনো চাকরি পাইনি, বাধ্য হয়ে গার্ডের চাকরি করি।’
এবার ভাবুন, যার নিজের সামাজিক, অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা নেই সে কী করে এতকিছুর মধ্যে থেকেও অন্যের নিরাপত্তা নিয়ে মাথা ঘামায়? যে লোকটাকে দিনের ভেতর ১২ ঘন্টা আপনার নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হয় সে লোকটার নিজের জীবন, ভবিষ্যতের নিরাপত্তার কথা কে ভাববে, সেটাই ভাববার বিষয়।
এত শোষণ-বঞ্চনার শিকার হলেও এই মানুষগুলোর মনোবল অন্যরকম। কথা বলতে গিয়ে দেখা গেল তাদের দায়িত্বজ্ঞান প্রবল। তারা বোঝেন তাদের ওপর বর্তানো কাজটা অত সোজা না। এর জন্য যে মনোবল দরকার হয় সেটারও কমতি নেই তাদের মাঝে।
সেটাই বললেন ডাচ-বাংলা ব্যাংকের একটি বুথের নিরাপত্তারক্ষী মো. আবুল বাশার। তারা ভাষায়, ‘আমি গার্ড। যদি নিরাপত্তা দিতেই না পারি, তাইলে আমারে রাখছে ক্যান? তাই সব সময় সজাগ থাকা লাগে, সতর্ক থাকা লাগে। সবচেয়ে বড় কথা হইল, বুথে কেউ ডাকাতি করতে আইলে আমারে কি ছাইড়া দিয়া যাইব? তাই নিজে নিরাপদ থাকি, অন্যরেও নিরাপদ রাখি।’
(ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন