পঞ্চাশের দশক থেকে বাংলাদেশে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। আর এবার (২০১৮) শেষ হলো ৫৩ বিশ্ব ইজতেমা। এ ইজতেমাগুলোতে এতদিন ধরে উর্দু ভাষায়ই হেদায়েতি বয়ান এবং মোনাজাত পরিচালিত হতো।
এবারই প্রথম বিশ্ব ইজতেমায় হেদায়েতি বয়ান এবং মোনাজাত বাংলায় পরিচালিত হলো। আর এতে উচ্ছসিত ও উৎফুল্ল হয়েছে বাংলাদেশের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান। বাংলা মোনাজাতে নিজেদের হৃদয়ের আবেগ-অনুভূতি শেয়ার করেছেন; বুঝে-শুনে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আমিন আমিন ধ্বনি ও চোখের পানিতে বুক ভাসিয়েছেন তারা।
এবারের ইজতেমার প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে হেদায়েতি বয়ান এবং আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেছেন যথাক্রমে বাংলাদেশে মাওলানা আব্দুল মতিন এবং কাকরাইল মসজিদে ইমাম ও তাবলিগের মুরব্বী হাফেজ মাওলানা মোহাম্মাদ জোবায়ের।
দ্বিতীয় ধাপের মোনাজাতে মাওলানা জোবায়ের অশ্রুসিক্ত নয়নে কম্পিত গলায় আল্লাহর কাছে আবেদন জানান। আর আমিন আমিন ধ্বনিতে পুরো ইজতেমা এলাকা প্রকম্পিত করে তোলেন অংশগ্রহণকারী মুসল্লিরা। মোনাজাতে তিনি আবেদন জানান-
>> হে আল্লাহ! আপনি আমাদের সেসব কল্যাণ দান করুন; যা আপনার কাছে নবিগণ প্রার্থনা করেছেন এবং সেসব অকল্যাণ থেকে আশ্রয় দিন; যা থেকে নবি-রাসুলগণ আশ্রয় চেয়েছেন।
>>আপনি আমাদের দুনিয়া-আখেরাতের কল্যাণ দান করুন। আমাদের অন্তরকে আপনার দ্বীনের ওপর স্থির করুন। আমাদের ঈমানে অবিচলতা দান করুন।
>> তিনি আরো বলেন, ‘হে আল্লাহ! আপনার বন্দেগি (ইবাদতকে) জিন্দা করে দেন। ইবাদত নসিব করেন। আপনার বন্দেগি আমাদের নসিব করেন। নাফরমানির (অন্যায়ের) জিন্দেগি খতম করে দেন।
>> হে আল্লাহ! আমাদের উপকারি ইলম দেন। জাহালত ও অজ্ঞতা দূর করে দেন। আপনার জিকির ও ধ্যান নসিব করেন। অন্তরে আপনার ধ্যান নসিব করেন। প্রতি মূহূর্তে আপনার ধ্যান নসিব করে দেন। মৃত্যুর সময় (অন্তরে) জিকির নসিব করেন।
>> হে আল্লাহ! আমাদের উত্তম আখলাক (চরিত্র) দান করেন। আপনার নবির মতো উত্তম আচরণওয়ালা বানিয়ে দেন। হে আল্লাহ! আমাদের ইখলাস (দ্বীনের কাজে একনিষ্ঠতা) নসিব করেন।
>> হে আল্লাহ! এ ইজতেমাকে কবুল করেন। এই বিশাল মেহনতকে কবুল করেন। আজিমুশশান কাজকে হেফাজত করেন। ফেতনা থেকে রক্ষা করেন।
>> হে আল্লাহ! আপনিই হেফাজতের জন্য যথেষ্ট। হে আল্লাহ পুরো উম্মতকে হেফাজত করেন। সারা পৃথিবীর মাখলুককে রক্ষা করেন। সবাইকে হেদায়াত দেন।
>> এ সময় ময়দানসহ আশপাশের চারদিকে প্রায় ১০ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে আল্লাহুম্মা আমিন ও কান্নার শব্দে পরিবেশ ভারি ও প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।
মাওলানা যোবায়ের মোনাজাতে বাতিল যেন নির্মূল হয়ে যায়; সেজন্যও আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থণা করেন। তিনি বলেন-
>> হে আল্লাহ! বাতিলকে নির্মূল করেন। বাতিলের পরিকল্পনা তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করেন। কদম নুসরত করেন। সহজ ও ইসরের মোয়ামালা করেন। কঠিন করেন না, সহজ করেন। রহম ও করমের মোয়ামালা করেন।
তাবলিগ জামাতের দ্বীনি ও দাওয়াতি কাজ যাতে আরও গতিশীল হয় এবং ইজতেমা যেন আল্লার দরবারে কবুল হয় সে জন্য তিনি তাঁর দোয়ায় বলেন-
>> আয় আল্লাহ! ইজতেমাকে ভরপুর কামিয়াবি করেন। এই কাজকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেন। ঈমানের হাওয়া ও হেদায়াতের হাওয়া চালু করে দেন।
>> আয় আল্লাহ! যারা ইজতেমা কামিয়াব (বাস্তবায়ন) করতে চেষ্টা করেছে, তাদের কবুল করেন এবং উত্তম বদলা দেন। যারা এ বয়ান শুনেছেন এবং যারা এখানে বয়ান করেছেন সবাইকে কবুল করেন।
এরপর তিনি দেশ ও জাতির জন্য আল্লাহর মাগফিরাত কামনা করেন। হইকাল ও পরকালের সফলতায় গোনাহ মাফে তার কাছে মিনতি করেন, ক্ষমা প্রার্থণা করেন। আল্লাহা তায়ালার সাহায্য কামনা করেন। আল্লাহর কাছে দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনে পরম শান্তির সাহায্য চান।
মাওলানা যোবায়ের আল্লাহর কাছে আরও আহ্বান জানান-
>> হে আল্লাহ! আপনি আমাদের রব, মালিক, মাবুদ। আপনি ছাড়া কেউ আমাদের মাফ করনেওয়ালা নেই। আপনি মাফ করেন। জান্নাত নসিব করেন। জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন।
>> হে আল্লাহ! জাহান্নামের আজাব সহ্য করার ক্ষমতা আমাদের নেই। যারা দুনিয়া থেকে ঈমান নিয়ে গেছে তাদের সবাইকে ক্ষমা করেন। যারা কিয়ামত পর্যন্ত আসবে তাদের সবাইকেও মাফ করে দেন।
>> হে আল্লাহ! আপনি আমাদের (দুর্বল) ভাঙাচোরা এ মেহনতকে কবুল করেন। ভুলে ভরা ইবাদতগুলো (ক্ষমাপূর্বক) কবুল করেন। দুনিয়াতে সব মন্দ ও বিপদ থেকে রক্ষা করেন, আখেরাতের জিন্দেগিতেও অমঙ্গল থেকে হেফাজত নসিব করেন।
বিশ্ব মুসলিমের কল্যাণ কামনায় তিনি বলেন-
>> হে আল্লাহ! আপনি সারা দুনিয়ার সব মুসলমানকে হেফাজত করেন। সব মুসলিম দেশকে রক্ষা করেন। সব মজলুমকে সাহায্য করেন। কুরআনকে জিন্দা করে দেন। কুরআনকে (বিধানকে) কায়েম করে দেন।
মোনাজাতে তিনি আরো বলেন-
>> হে আল্লাহ! যে যেখানে হাত তুলেছেন; আপনি কারো হাত খালি ফিরিয়ে দিয়েন না। আমাদের দোয়া (চাওয়াগুলোকে) মেহেরবানি করে কবুল করে নেন। হে আল্লাহ, আপনি আমাদের কবুল করেন, আপনি সর্বশ্রোতা ও করুণাময়।
উল্লেখ্য যে, দীর্ঘদিন ধরে আখেরি মোনাজাত ও মোনাজাত পূর্ব হেদায়েতি বয়ান দিল্লির মারকাজ থেকে আসা মুরব্বিরা উর্দুতে করে আসছিলেন। এবারই প্রথম বাংলাদেশের মুরব্বীরা শেষ দিনের এ গুরুত্বপূর্ণ ২টি কাজ হেদায়েতি বয়ান এবং মোনাজাত বাংলায় আঞ্জাম দেন।
বিশ্ব ইজতেমা বাংলাদেশে হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই বাংলা ভাষা-ভাষি মানুষ বেশি অংশ গ্রহণ করে। আর বাংলায় মোনাজাত হওয়ায় মানুষ নিজেদের আবেগ-অনুভূতি অন্তর থেকে শেয়ার করার সুযোগ পায়।
এ কারণেই হেদায়েতি বয়ান ও মোনাজাত বাংলায় হওয়ায় অংশগ্রহণকারীরা শোকরিয়া ও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। অন্তরের আবেদনগুলো, মনের আকাঙ্ক্ষাগুলো, হৃদয়ের হাহাকারগুলো আমিন আমিন ধ্বনিতে প্রকাশ করেন। চোখের অশ্রু বন্যায় একাকার হয়ে যান।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন