ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউয়ের সংসদ সদস্য ভবন (ন্যাম ভবন) থেকে সাতক্ষীরার সাংসদ মুস্ত্মফা লুৎফুলস্নাহর ছেলে অনীক আজিজ স্বাক্ষরের ঝুলন্ত্ম লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
সুরতহালে পুলিশ এ ঘটনাকে আত্মহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে, একই মতপ্রকাশ করেছেন ময়নাতদন্ত্মকারী চিকিৎসক।
শেরেবাংলা নগর থানার ওসি গনেশ গোপাল বিশ্বাস বলেন, রোববার সকালে খবর পেয়ে তারা ৫ নম্বর ভবনে সাংসদের বাসা থেকে অনীকের ঝুলন্ত্ম লাশ উদ্ধার করেন।
পরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে অনীকের ময়নাতদন্ত্ম হয়।
২৭ বছর বয়সী অনীক খুলনার সিটি পলিটেকনিক থেকে ইলেক্ট্রিক্যালে ডিপেস্নামা করে বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্য ঢাকা থেকে আইইএলটিএস করছিলেন। পাশাপাশি পাঠশালায় ফটোগ্রাফির কোর্স করছিলেন তিনি।
শেরেবাংলা নগর থানার এসআই শফিকুর জানান, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের তার গলায় পেঁচানো অবস্থায় অনীকের দেহ শোবার ঘরের ফ্যান থেকে ঝুলছিল। তার শরীরে আর কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
অনীকের লাশের ময়নাতদন্ত্ম করেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এ এম সেলিম রেজা।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনে যা
লেখা হয়েছে, ময়নাতদন্ত্ম করে তারও একই ধারণা হয়েছে।
পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনে কী ছিল জানতে চাইলে এই চিকিৎসক বলেন, 'লেখা ছিল গলায় তার পেঁচিয়ে আত্মহত্যা। আমার ফাইন্ডিংসেও তাই পাওয়া গেছে।'
অ্যাডভোকেট মুস্ত্মফা লুৎফুলস্নাহ বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিট বু্যরোর সদস্য। সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) আসন থেকে এবারই প্রথম তিনি এমপি হয়েছেন।
শনিবার রাতে ন্যাম ভবনের ওই বাসায় ছিলেন অনীক, তার বোন অদিতি আদৃতা সৃষ্টি এবং তাদের পরিবারের এক ড্রাইভার।
সাংসদ মুস্ত্মফা লুৎফুলস্নাহ ও তার স্ত্রী নাসরীন খান লিপি শনিবার ছিলেন সাতক্ষীরায়। রোববার সকালেই তারা ঢাকায় ফেরেন।
সাংসদের ব্যক্তিগত সহকারী মফিজুল হক জাহাঙ্গীর বলেন, 'রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে সবাই ঘুমাতে যায়। সকালে সবাই উঠলেও অনীক উঠছিল না। অনেক ডাকাডাকির পরও সাড়া না পেয়ে বিকল্প চাবি দিয়ে ঘরের দরজা খুলে ভেতরে লাশ পাওয়া যায়।'
অনীকের চাচা আবদুলস্নাহ আল মর্তুজা বলেন, 'আমরা ওর ল্যাপটপ, মোবাইল চেক করে দেখার চেষ্টা করছি। জানি না কীভাবে কী হলো।'
অসহায়দের ছবি
তুলতেন অনীক
অনীক আজিজ স্বাক্ষর। বয়স মাত্র ২৭। তারম্নণ্যের আবেগে মাতিয়ে রাখতেন চারপাশ। প্রিয় ক্যামেরা নিয়ে সারাদিন ছুটে বেড়াতেন পথেপ্রান্ত্মরে। সমাজের অসহায়দের ছবি তুলে ফেসবুকে প্রচার করে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। জড়িত ছিলেন গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গেও। মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন প্রতিনিয়ত। কিন্তু তার হঠাৎ আত্মহত্যায় সবাইকে অবাক করে দিয়েছে।
তার এ চলে যাওয়া কারও কাছে সহজবোধ্য নয়। তবে রাজধানীতে এমপিদের বাসস্থান ন্যাম ফ্লাটের কর্মচারীরা বলাবলি করছেন প্রেমই কাল হলো তার।
মরদেহ ময়নাতদন্ত্মের জন্য সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। এ সময় হাসপাতালের মর্গের সমানে কথা হয় দৈনিক দক্ষিণের মশাল'র নির্বাহী সম্পাদক ও জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের সিনিয়র সভাপতি মিনাজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি এমপি মুস্ত্মফা লুৎফুলস্নাহর বন্ধু।
তিনি বলেন, 'মুস্ত্মফা ভাই তাদের বাচ্চাদের নিয়ে সবার বাসায় যেতেন। আমি তাকে শিশুকাল থেকে চিনি। অনীকের ভেতরে কোনো ভাব ছিল না। নিরীহ একটি ছেলে। খুব সাদামাঠা জীবন-যাপন করত। ওর ভেতরে কোনো অহমিকা বোধ ছিল না। কাউকে কোনো দিন কষ্ট দিয়ে কথা বলেনি। কখনো কারও সঙ্গে তর্ক করেনি। রাগ দেখায়নি।'
তিনি আরও বলেন, অনীকের শখ ছিল ছবি তোলা। নিপীড়িত মানুষের ছবি তুলে ফেসবুকে আপ করত। কোনো নিপীড়ন বা অনিয়ম দেখলেই ছবি তুলে ফেসবুকে দিত। সে ছাত্রমৈত্রী করত। এমপির ছেলে হিসেবে সে কখনো স্পেস দখল করেনি। এমনকি এমপির গাড়ি ব্যবহার করে দশ হাত দূরেও যায়নি। গণজাগরণ মঞ্চে এক মাসেরও বেশি সময় ও মুক্তিযুদ্ধের ছবি প্রদর্শন করেছিল। প্রতিদিন রাত ৮টার পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ছবিগুলো দেখাত সে। পজেটিভ বাংলাদেশ গড়ার জন্য সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে অনীক।
অনীকের ছোটবোন আদৃতা সৃষ্টি বলেন, 'বাবা-মা'র সঙ্গে খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল ভাইয়ের। ছেলে আর বাবা এক জায়গায় বসে থাকলেও কেউ কখনো বুঝতে পারত না তারা বাবা-ছেলে। বাবা কখন বাবার জায়গা থেকে কথা বলেনি। বন্ধুর মতো ইয়ার্কি ফাজলামি করেছে। আত্মহত্যার আগেও আমরা রাত ১১টা পর্যন্ত্ম গল্প করেছি। এরপর কী হয়েছে আমি কিছুই বলতে পারব না।'
অনীকের এক আত্মীয় জানান, পড়ালেখার চেয়ে মানুষের কল্যাণে সবসময় নিবেদিত ছিল অনীক।
অনীকের ফেসবুক ঘেঁটে পারিবারিক কয়েকটি ছবিতে বাবা-মা আর দুই ভাইবোনকে হাস্যোজ্জ্বল দেখা যায়। এছাড়াও প্রকৃতির সুন্দর দৃশ্যও ধারণ করে ফেসবুকে দিত সে। ছবি তোলার শখ থেকেই পাঠশালায় ফটোগ্রাফির কোর্স করেছিলেন তিনি।
প্রেমের কারণে আত্মহত্যা?
সকালে ন্যাম ফ্ল্যাট সরেজমিনে দেখা যায়, এমপির ফ্ল্যাটটি তালাবদ্ধ। মরদেহ সুরতহালের জন্য সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। সেখানেই গেছেন সবাই। তবে ফ্ল্যাটের নিচে দায়িত্বরত কর্মচারীরা বলাবলি করছিলেন, একটি মেয়ে প্রায়ই অনীকের কাছে আসত। মেয়েটির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এ প্রেমই নাকি আত্মহত্যার কারণ। তবে এ বিষয়ে তারা আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দিতে চায়নি।
নিজ এলাকার এক অধিবাসী নারী এসেছিলেন এমপির সঙ্গে দেখা করতে। তিনি এসে শোনেন এমপির ছেলে আত্মহত্যা করেছেন। ওই নারীও আফসোস করে বলেন, তাহলে সেই প্রেমই কি কাল হলো?
তবে এ বিষয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও কেউ কোনো মন্ত্মব্য করেননি।
দুপুর ১টায় রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে মরদেহের ময়নাতদন্ত্ম হয়। এ সময় হাসপাতালে এমপি, মরহুমের বোন আদৃতা সৃষ্টি ছাড়াও আত্মীয়-স্বজন ও এলাকার লোকজন উপস্থিত ছিলেন। এরপর হেলিকপ্টারে তাকে সাতক্ষীরায় নেয়া হয়।
শেষ স্ট্যাটাস 'তোর
হজন্য চিঠির দিন...'
অনীকের শেষ ফেসবুক স্ট্যাটাস ছিল 'তোর জন্য চিঠির দিন।' যে স্ট্যাটাসটি অনীক ভোর ৪টা ০৫ মিনিটে ফেসবুকে আপডেট করেছেন। কিন্তু সকালেই ঘরের দরজা ভেঙে ভেতরে পাওয়া যায় তার ঝুলন্ত্ম মরদেহ।
অনীকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অম্বিক মন্ডল বলেন, 'ঢাকার ফার্মগেট এলাকার একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছিল অনীক। অনীক ওয়ার্কার্স পার্টির কর্মী ছিল। গত ২-৩ দিন আগে মোটরসাইকেলযোগে অনীক ঢাকায় গিয়েছিল। সেদিনই তার সঙ্গে তার শেষ কথা হয়। পরিবারের সঙ্গে তার কোনো মতভেদ ছিল বলে কখনো কিছু বলেনি সে। বরং পরিবারের সবাই তাকে খুব ভালোবাসত। কী কারণে আত্মহত্যা করল সেটা ধারণাই করতে পারছি না।'
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন