অভিজাত পাড়ায় ওদের চলাফেরা। রাত হলে তাদের হাঁকডাক শুরু হয়। আছে বডিগার্ড। সঙ্গে দামি গাড়ি। রাতেও আবার তারা ব্যবহার করেন সানগ্লাস। কালো পোশাক আর মুখোশ পরা অবস্থায় বেশিরভাগ রাতে তাদের দেখা যায়। এরা সমাজের হাইপ্রোফাইল শ্রেণি। কিন্তু মুখোশ লাগিয়ে চলাফেরা করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের চিহ্নিত করে রেখেছে। ছদ্মবেশী গোয়েন্দারা সংগ্রহ করেছেন গোপন ভিডিও এবং ছবি। সময় সুযোগ পেলে গোয়েন্দারা সেই ছবি ও ভিডিও কাজে লাগাবেন। আর তখনই মুখোশ উন্মোচন হবে হাইপ্রোফাইল ব্যক্তিদের। জানা যাবে দিনের আলোয় স্যুটকোট-টাই পরা উঁচুদরের লোকদের অন্ধকার জগতে বিচরণের রগরগা কাহিনী।
এ তালিকায় আবার আছেন নব্য ধনী ও তাদের দুলালরা। সমাজে এদের কেউ কেউ নতুন তালিকার কোটিপতি। তবে দিনের আলোয় এদের দেখা মেলে কম। শেষ বিকেলে এরা নিজ অফিসে বসেন। গভীর রাতে প্রাইভেট পার্টিতে এসে ভোরের আলোয় ঘরে ফেরেন। অন্ধকার জগতে আসা এসব মুখোশ পরা ব্যক্তির জন্য নিয়োজিত থাকে একদল ‘রাতের রানী’। সম্প্রতি গোয়েন্দারা একটি প্রাইভেট সেন্টার থেকে কয়েক ব্যক্তির জীবনযাপন এবং আয়-ব্যয়ের চাঞ্চল্যকর তথ্য উদ্ধার করেছেন। যাতে করে এসব ব্যক্তির ওপর আয়করের বোঝা উপযুক্তভাবে বসানো যায়, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হতে পারে বলেও সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে।
রাজধানীর বনানীর ১১ নম্বর রোডের একটি বাড়ি। ভবনের বাইরে বেশ চাকচিক্য। প্রধান ফটকটির একটি অংশ প্রায় সময় খোলা থাকে। রাতে কিছুক্ষণ পরপর ফটক খুলতে হয় বলে একটি অংশ খোলা রাখা হয়। ভবনের একটি ফ্লোরজুড়ে হয় প্রাইভেট পার্টি। দিনের আলো নিভতে শুরু করলে এখানে আনাগোনা হতে থাকে রাতের রানীদের। এই পার্টিতে যারা আসেন তারা সমাজের উঁচুদরের মানুষ। কালো, সাদা ও ছাই কালারের কাপড় দিয়ে তৈরি মুখোশ পরা অবস্থা এরা আসেন। খোঁজ পেয়ে রাতের ঢাকায় এমন মুখোশ পরা ব্যক্তিদের বিষয়ে গোয়েন্দারা তথ্য সংগ্রহ শুরু করেন। কয়েকদিন আগে বনানীর ওই পার্টি থেকে নেমে আসার পর অনেকটা জোর করেই একজনের মুখোশ খুলে দেখেন গোয়েন্দারা। সন্দেহজনক এই মুখোশ পরা ব্যক্তিদের প্রোফাইল পর্যালোচনা করে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দারা জানতে পারেন, মুখোশ পরা ব্যক্তিদের তালিকায় যেমন ধনীর দুলাল আছেন তেমনি আছেন নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক নেতারাও। আছেন ব্যবসায়ী, তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী, গাড়িচোর সিন্ডিকেট এবং বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিরা।
কূটনৈতিক এলাকা গুলশানে হোটেল ওয়েস্টিনের আশপাশেই একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। নিচতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত ভবনটি অফিসের কাজে ব্যবহৃত হয়। বাদবাকি ওপরের তলাগুলো আবাসিক হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। সন্ধ্যা নামলেই এই অফিস থেকে বেশ কয়েক পাকিস্তানি নাগরিক বের হন। যাদের গন্তব্য বনানীর ১১ নম্বর রোডের সেই প্রাইভেট পার্টি। এই ভিনদেশিদের সঙ্গে প্রায় আড্ডা দেন শিল্প প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। রাত নেমে আসলেই রাতের গুলশান বনানীতে দামি গাড়ি হাঁকিয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার মাস্তিতে নেমে পড়েন। আর তার সঙ্গে প্রায় আড্ডা দেন একসময় গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া কথিত মডেল প্রিয়াঙ্কা জামান। এই মডেলকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তরের একটি টিম লিবিয়ান তিন মাফিয়াচক্রের সদস্যসহ গ্রেফতার করেছিল। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক একজন মুখোশ পরা। রাতে তিনি গুলশান-বনানীতে নামলে মুখোশ পরা অবস্থায় চলাফেরা করেন। প্রতিষ্ঠানের কোনো চালক রাখেন না।
কলাবাগান থেকে প্রতিদিন গুলশানে আসেন কথিত মডেল তাবাসসুম। বারিধারা এলাকা থেকে আসা আরেক মুখোশ পরা ব্যক্তির সঙ্গী তিনি। সম্প্রতি গোয়েন্দাদের একটি দল মুখোশ পরা এই ব্যক্তির সঙ্গে গুলশানের একটি চেকপোস্টে কথা বলেন। গাড়ি থামার পর ভেতরে গোয়েন্দারা একজন মেয়েকে দেখতে পান। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলে তিনি নিজেকে মডেল তাবাসসুম বলে পরিচয় দেন। গোয়েন্দারা তার সম্পর্কে আরো জানতে নাম, ঠিকানা এবং মোবাইল নম্বর সংগ্রহে রেখে দেন। কিন্তু ওই রাতে তাকে আটকের মতো কোনো তথ্য বা সন্দেহ তৈরি না হওয়ায় কাউকে অহেতুক হয়রানি করেননি জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
দামি দামি গাড়ি ভাড়া নিয়ে গুলশান বনানীতে ঘুরেন ইমু নামের আরেক মডেল। উঁচুদরের এই নারী প্রতারকের আছে বিশাল গ্যাংস্টার। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও গুলশান থানা পুলিশ ইমুকে গ্রেফতার করেছিল। দ্বিতীয় দফায় গ্রেফতারের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তার সঙ্গে দেশের বেসরকারি খাতের একটি ব্যাংকের মালিক পর্যায়ের পরিবারের সদস্যকে আটক করেছিল। আটকের পরদিন মুচলেকা দিয়ে আদালত থেকে জামিন নেন প্রতারক ইমু ও তার সেই বন্ধু। বনানীর ৮ নম্বর রোডের একটি বাড়িতে বর্তমানে ইমু, তার বান্ধবী আনিকা ও তানিয়াসহ প্রায় সেই বন্ধু প্রাইভেট পার্টিতে আসা-যাওয়া করেন। কিন্তু ইমুর এই বন্ধুও এখন মুখোশ পরাদের তালিকায়।
বনানী এলাকায় নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন এমন একজন খোঁজ দিলেন আরো কয়েক মুখোশধারীর বিষয়ে। এদের প্রায় সময় বিচরণ বনানীর ৮ নম্বর রোডের একটি বহুতল বাড়ি ঘিরে। এই বাড়িতে আবার শোবিজ জগতের বিশেষ ব্যক্তির আনাগোনা হয়। আছে মদের পার্টি। গানবাজনা আর হৈ হুল্লোড়। এই ফ্ল্যাটটির ভাড়া মাসপ্রতি ৫ লাখ টাকা। এখানে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করেন একজন টিভি উপস্থাপিকা। আবার তার গাড়িতে যারা আসেন তারাও মুখোশধারী। এক নারীকে প্রায় সময় টকশোতে এবং সামাজিক মাধ্যমে লাইভে আসতে দেখা যায়। তিনি আবার জমকালো আড্ডায় আসেন। এই নারীকে ঘিরে বর্তমানে একটি গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধান চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে তার আর গ্রেফতার এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। কারণ তার বিরুদ্ধে একগাদা অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে একটি গোয়েন্দা দল।
হাইপ্রোফাইল ব্যক্তিদের মধ্যে একজন আছেন শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারি করে টাকা কামিয়েছেন। কথিত টিভি উপস্থাপিকা আবার তার গাড়িতে আসেন। একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, তার ভাগ্নে, মার্কিন প্রবাসী একজন কথিত নতুন প্রজšে§র নেতাও আসেন এখানে। এরা এখন সবাই মুখোশ পরা ভদ্রলোক। মুখোশ লাগিয়ে এরা নিজেদের চরিত্র ঢাকতে চান।
গুলশানের ডলি, মেহেবুবা, করবী, পাপ্পু, জিয়া, হাসান, সালমান, আরমান, একটি রাজনৈতিক দলের তুখোড় বক্তা। মিনিটে বহু কথা বলেন। সাদা চামড়ার তরুণ রাাজনৈতিক নেতাও মুখোশ পরা অবস্থায় আসেন। গুলশান, বনানী, বারিধারার মতোই উত্তরা, ধানমণ্ডি, নিকুঞ্জজুড়ে এখন মুখোশ পরা ধনীদের আনোগোনা বেড়েছে। এসব ধনীর বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে কোনো সময় কঠোর হতে পারে। কারণ হিসেবে জানা গেছে, অনেকে আবার ‘পাওয়ার’ দেখান। এসব বিষয় অবগত আছেন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা। বেশ কিছুদিন আগে বিমানবন্দর সড়ক সংলগ্ন একটি পাঁচ তারকা হোটেলে এমন ‘পাওয়ার’ দেখানোর ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় গোয়েন্দারা দেশের একটি বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের ছেলেকে কিছুক্ষণের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। তিনি বেসামাল অবস্থায় এক কূটনীতিকের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। জানা যায়, এই ছেলেকে রক্ষার জন্য বাবা রাতব্যাপী তৎপর ছিলেন। কর্ণধারের সেই ছেলেও একজন এখন মুখোশ পরা দুলাল। তার সঙ্গে চট্টগ্রামের এক বাসিন্দা কথিত এক উপস্থাপিকার গভীর সম্পর্ক। রাতের ঢাকার পাঁচতারকা হোটেলে এরা শিসা পার্টিতে অংশ নেন। সপ্তাহখানেক আগে গুলশানের একটি হোটেলের ছাদে শিসা পার্টিতে বসার জায়গা নিয়ে ওই উপস্থাপিকার সঙ্গে এক মডেলের বাকবিতণ্ডা ঘটে। একপর্যায় একজন আরেকজনের ওপর পানির গ্লাস নিক্ষেপ করেন।
মানবকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন