সম্প্রতি সামজিক গণমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির কিছু ছবি নিয়ে যে বিতর্কের ঝড় তৈরি হয়েছে তা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া উচিত দিল্লি’র পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তা ব্যক্তিদের। সুদর্শন ভদ্র মহিলা ও ভদ্রলোকদের এসব ছবি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কে সর্বশেষ ভয়াবহ বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
একটি ছবিতে দেখা যায়, ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জীকে। তার সঙ্গে রয়েছেন স্বনামধন্য কয়েকজন বাংলাদেশী ও ঢাকায় ভারতের হাই কমিশনার। প্রণব মুখার্জী ব্যক্তিগত সফরে ঢাকা যাওয়ার পর এ ছবিটি তোলা হয়েছে। ছবিতে তিনি একটি চেয়ারে বসে আছেন। অন্যরা তার পিছনে দাঁড়ানো। এই আয়োজনে ‘বাঙালি মর্যাদা’য় আঘাত করা হয়েছে সামাজিক মিডিয়া ব্যবহারকারীরাদের অনেকের। তারা কড়া নজর রাখছিলেন বিষয়টিতে। এতে তীব্র প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ছে।
বলা হচ্ছে, এতে ভারতের ‘বিগ ব্রাদার’ সুলভ মনোভাব প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিক মনোভাবের অভিযোগ আনা হয়েছে। কেউ কেউ এই ফটোগ্রাফকে ‘ড্যানিশ ঔপনিবেশের’ সময়কার ফটোগ্রাফ বলে অভিহিত করছে। যেখানে ড্যানিশ ঔপনিবেশবাদ একটি চেয়ারে বসে ছিলেন এবং তার দেশবাসী তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। দাসসুলভরা মাটিতে অবস্থান করছিলেন।
এই বিতর্ক এতটাই ঝাঁঝালো হয়েছে যে, ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশন এই ছবিগুলো তাদের সরকারি ফেসবুক ও টুইটার পেজ থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ভারতীয় হাই কমিশনের একটি সূত্র বলেছেন, এটা একটি দুর্ভাগ্যজনক বিষয়। আমরা কোনো রকম বিতর্ক চাই না। তাই ছবিগুলো সরিয়ে নিয়েছি।
একটি ছবিতে দেখা যায়, প্রণব মুখার্জী বসে আছেন। তার পাশে ঘিরে দাঁড়িয়েছেন ভারতীয় হাই কমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা, বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও স্বৈরাচার-কাম সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী, বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। ভারতীয় হাই কমিশনের একটি অনুষ্ঠানের পর তোলা হয়েছে এই ছবি।
বাংলাদেশে এমনিতেই ভারত বিরোধী একটি অবস্থান আছে। এ অবস্থানের কারণে রাজনীতি বিভক্ত। বাংলাদেশ যখন নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তখন এই ছবি আবেগে যথেষ্ট নাড়া দিয়েছে।
গত কয়েকদিন ধরে এ নিয়ে সামাজিক মিডিয়ায় সমালোচনার বন্যা বয়ে যাচ্ছে। তাতে বলা হচ্ছে, কিভাবে চেয়ারে বসা প্রণব মুখার্জীর (৮২) পিছনে এভাবে দাঁড়িয়ে নিজেদেরকে ভারতীয় ঔপনিবেশিকতার অধীনস্ত হিসেবে দেখাতে পারেন বাংলাদেশের আইন প্রণেতারা। ভারতের সাবেক এই প্রেসিডেন্ট পাঁচ দিনের সফরে বাংলাদেশ যান। তিনি দিল্লি ফিরে এসেছেন ১৮ই জানুয়ারি। কিন্তু সামাজিক মিডিয়ায় এ নিয়ে বিতর্কের অবসান হচ্ছে না।
উপরন্তু হাই কমিশন হর্ষবর্ধন শ্রিংলার সাম্প্রতিক একটি বিবৃতি প্রত্যাহার করেছে। ওই বিবৃতিতে তিনি বাংলাদেশে হিন্দির উজ্বল ভবিষ্যত সম্পর্কে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। তার এই বিবৃতিতে ঢাকায় একটি শ্রেণির মানুষকে ক্ষুব্ধ হতে দেখা যায়। কলামনিস্ট মাসুদা ভাট্টি বলেছেন, এরা সবাই ভারত বিরোধী। তারা ভারত বিরোধিতার দোহাই দিয়ে একটি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে সেখান থেকে সুবিধা নিতে চায়। এ বছরের শেষের দিকে যেহেতু নির্বাচনের শিডিউল আছে তাই এসব মানুষ খুব বেশি তৎপর হয়ে উঠেছে।
সামাজিক মিডিয়ায় এই ছবির বিরুদ্ধে প্রচারণার নেতৃস্থানে রয়েছেন একজন চিকিৎসক পিনাকি ভট্টাচার্য। তিনি বলেছেন, তার মন্তব্যের মধ্যে ভারত বিরোধিতার কিছুই নেই। তিনি বলেন, গত ১০ বছর ধরে প্রকাশ্যে ভারত যে আধিপত্য বিস্তার করে আছে এই ছবি তারই প্রকাশ। এই ছবি বলে দিচ্ছে কিভাবে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা ও সাংস্কৃতিক অভিজাতরা ক্রমবর্ধমান হারে বশ্যতা স্বীকার করে নিচ্ছেন। তাদের এ কর্মকান্ড সব মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করছে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জীর সম্মানে ১৪ই জানুয়ারি আয়োজিত ভারতীয় হাই কমিশনের নৈশভোজে উপস্থিত হয়েছিলেন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা। তারা বলেছেন, যারাই তার সঙ্গে ছবি তুলতে চেয়েছেন তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে প্রণব মুখার্জী হাসিমুখে তাতে সহযোগিতা করেছেন।
ভারতীয় হাই কমিশনের একটি সূত্র বলেছেন, তার সঙ্গে সাক্ষাত করতে কমপক্ষে ১৭ থেকে ১৮টি গ্রুপ গিয়েছিলেন। তিনি তাদের সবার সঙ্গেই ধৈর্য্য ধরে পোজ দিয়েছেন। প্রতিটি গ্রুপে ছিলেন বেশ কয়েকজন করে মানুষ। প্রতিটি ফটোসেশনে সময় লেগেছে দু’ থেকে তিন মিনিট পর্যন্ত।
ভারতীয় হাই কমিশন তার ফেসবুক পেজ থেকে দ্রুত ছবিগুলো সরিয়ে নিয়ে বাংলাদেশে বিতর্কের ঝড় প্রশমনে কিছুটা হলেও প্রশংসনীয় কাজ করেছে। তবে ভারতকে মনে রাখতে হবে যে এই ঝড় পুরোপুরি বন্ধ করতে হলে তাদেরকে আগামী ১২ মাসে আরো অনেক কিছু করতে হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন