নড়াইলের মেয়ে ইলোরা পারভীন নিপুণ হাতে সুই-সুতো দিয়ে গেঁথেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের দৃষ্টিনন্দন ছবি। সুই-সুতোয় আলপনা তুলে কারুকাজ খচিত বঙ্গবন্ধুর পরিবারের এ ছবি সবার নজর কেড়েছে।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের ছবি ব্যতিক্রমী নকশায় খচিত করতে পেরে ইলোরা গর্বিত। সুই-সুতোয় আলপনা এঁকে নতুন বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে বুনেছেন তিনি।
তার আলপনায় সত্যিকার অর্থে জীবন্ত মানুষের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। স্বামী, সংসার ও মেয়েসহ পরিবারের সব কাজ সামলে সুই-সুতোয় আলপনা আঁকা চিত্রশিল্পী হিসেবে নিজেকে নতুনভাবে পরিচিত করেছেন ইলোরা পারভীন (৪৪)।
ইলোরার বাবার বাড়ি নড়াইল পৌর এলাকার মাছিমদিয়া গ্রামে। এ গ্রামেই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের জন্ম। সুলতানের বাড়ির পাশেই ইলোরার জন্মভিটা। ইলোরার বাবা মরহুম হাবিবুর রহমান বরেণ্য চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের বাল্যবন্ধু ছিলেন।
ইলোরার পরিবারের সদস্যরা জানান, শৈশব থেকে ছবি আঁকার শখ ইলোরার। এ কারণে তিনি মাঝে-মধ্যে এসএম সুলতানের বাড়িতে গিয়ে উঁকি দিতেন। গভীর দৃষ্টিতে দেখতেন সুলতানের অংকন কৌশল। ছবি আকার প্রতি আগ্রহ থাকায় শিশুপ্রেমী সুলতানও ভালোবাসতেন ইলোরাকে। উৎসাহ দিতেন ইলোরাকে। এ আগ্রহ থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের ছবি আকার স্বপ্ন দেখেন। অবশেষে সে আশা বাস্তবে রূপ দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন।
ইলোরা জানান, ১৯৯৮ সালে ইডেন মহিলা কলেজের দর্শন বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাসের পর জন্মভূমি নড়াইলের মাছিমদিয়ায় আসেন তিনি। ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর এসএম সুলতান মারা যাওয়ার পর সুলতানের শিষ্য দুলালের কাছে চিত্রকর্মের কাজ শেখা শুরু করেন তিনি। সুই-সুতোয় ছবি আঁকা কঠিন। বারবার অনুশীলনে এটা সম্ভব বলে ইলোরাকে জানালেন দুলাল।
চিত্রাংকনে দুলাল ইলোরাকে ব্যাপক উৎসাহ দিতেন। বছর দুয়েক আগে দুলালের মৃত্যুতে ইলোরা ভীষণ কষ্ট পান। দুইজন চিত্রগুরুর (এসএম সুলতান ও সুলতানের শিষ্য দুলাল) মৃত্যুর শোক কেটে উঠে নতুন উদ্দীপনা নিয়ে চিত্রকর্মের কাজ শুরু করেন ইলোরা।
একটি বইয়ের কভার পেজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দেখে সেলাইয়ের মাধ্যমেই ইলোরা এ পথে হাটতে শুরু করেন ১৯৯৮ সালে। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মোট ৩৫টি শিল্পকর্ম শেষ করতে সক্ষম হন তিনি। প্রতিটি চিত্রকর্ম শেষ করার তারিখ সুই-সুতো দিয়ে লেখা হয়েছে। তার চিত্রশিল্পে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবার। এ ধরনের চিত্রকর্মের সংখ্যা ১৭টি।
এসবের মধ্যে দাঁড়ানো অবস্থায় বঙ্গবন্ধু ও তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি রয়েছে। একক বঙ্গবন্ধুর ৭টি ছবি। আছে বঙ্গবন্ধুর বাবা, মা ও শেখ রাসেলের ছবি। শেখ হাসিনা ও জয়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখ ও সুলতানা কামালের ছবি। এককভাবে আছে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসার ছবি, একক শেখ হাসিনার ছবি। শেখ হাসিনার পাঁচ ভাই-বোনের যৌথ ছবি। এসবের একটি ইলোলার বড় ভাই স্থানীয় চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ও আওয়ামী লীগ নেতা হাসানুজ্জামানের অফিসে ফ্রেমে বাঁধাই করা এবং অবশিষ্ট ছবিগুলো নিজ বাসার ফ্রেমে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
ইলোরা বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে আমার হাতেখড়ি। একটি ছবি শেষ করার পর ভাবি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আর আঁকবো না। কিন্তু আবার চলে যাই বঙ্গবন্ধুর অন্য ভঙ্গির ছবিতে। বঙ্গবন্ধু ও তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে চিত্রকর্মটি ফ্রেমসহ দৈর্ঘ্য ৩০ ইঞ্চি আর প্রস্থ ২১ ইঞ্চি। বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও শেখ হাসিনার পাঁচ ভাই-বোনের ছবির আকৃতির দৈর্ঘ্য ৩০ ইঞ্চি আর প্রস্থ ২১ ইঞ্চি অথবা এর চেয়ে সামান্য কম বেশি।
এছাড়া একটি করে ভাষা আন্দোলন, রায়ের বাজারের বধ্যভূমি, জাতীয় সম্পদ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, এসএম সুলতান, নববধূ, পাখি, নিজের মা নূরজাহান, ভাই আলহাজ মো. ওয়াহিদুজ্জামানসহ নিজের ছবি এঁকেছেন ইলোরা।
৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৩ ফুট প্রস্থের ভাষা আন্দোলনের ছবিটি আঁকতে সময় লেগেছে ২ বছর। ৪২/২০ ইঞ্চি আকৃতির বধ্যভূমির ছবি আঁকতে সময় লেগেছে চার মাস। পত্রিকায় ছাপা দেখে শেখ হাসিনার পাঁচ ভাই-বোনের ছবি আঁকতে সময় লেগেছে চার মাস।
ইলোরা বলেন, সময় বেশি লাগে গলা, হাত, পরনের কাপড়ের ভাঁজ তুলতে। কোনো কোনো ছবির চোখ আঁকতেই ১৫-২০ দিন সময় লেগে যায়। সামান্য এদিক-ওদিক হলেই পুরো কাজ শেষ।
ইলোরা সাত ভাই-বোনের মধ্যে পঞ্চম। ১৯৯৯ সালে তিনি মো. ফয়জুল্যাহ বিশ্বাসের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সংসার জীবনে পা দেন। তার দুই মেয়ে হুমাইয়রা ফয়েজ অষ্টম শ্রেণিতে ও নাফিসা ফয়েজ দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আজিমপুর শাখায় অধ্যয়নরত। এ পর্যন্ত নিজ শিল্পকর্মগুলো কোথাও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে পারেননি তিনি। কোথায় এসব করতে হয়- সেসব তার অজানা।
সম্প্রতি ইলোরার সুই-সুতায় গাঁথা শেখ রাসেলের একটি ছবি ধানমন্ডি-৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে প্রদর্শন করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু পরিষদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সুই-সুতায় গাঁথা এ ছবি দেখে অভিভূত হন। এ ধরনের দুর্লভ ছবি সারা বিশ্বে চায়না ও ভিয়েতনামে কিছু দেখা যায় বলেও মন্তব্য করেন তারা।
সুই-সুতোয় নানা আলপনা অাঁকার মাঝে নতুন বঙ্গবন্ধুকে বুনছেন ইলোরা। তার একেক চিত্রকর্ম জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। যেন অসম্ভব এক বাস্তবতা। যে কেউ তার চিত্রকর্ম দেখলে আশ্চর্য হবেন। সুই-সুতোয় আলপনা অাঁকা কারিগর ইলোরা পারভীন নড়াইলের গৌরব।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন