ঢাকার উপকণ্ঠ আশুলিয়ার এক ব্যক্তির টয়োটা এক্সিও (মডেল ২০০৯) গাড়ি চালান আব্দুল্লাহ (৩১)। গাড়িটি ভাড়ায় চলে। রাতেও কাজ শেষে এই চালকের হেফাজতে গাড়িটি থাকে। আর তখন ভাড়ায় না চালিয়ে ছিনতাইকারীদের হাতে গাড়িটি তুলে দিতেন আব্দুল্লাহ। এরপর গাড়ি নিয়ে দলটি ঢাকা ও ঢাকার উপকণ্ঠে দাপিয়ে বেড়াতো। পথচারী ও যাত্রীদের ব্যাগ টেনে নিতো তারা। কখনো যাত্রীকে গাড়িয়ে তুলে ছিনতাই করতো। এই ছিনতাইকারী দলটির নির্মমতার শিকার হয়ে গত ২৬ জানুয়ারি ভোরে ধানমণ্ডির ৭ নম্বর রাস্তার মাথায় প্রাণ হারান হেলেনা বেগম নামে এক নারী। চাঞ্চল্যকর সেই ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করেছে পুলিশ। গত সোমবার আশুলিয়া থেকে চালক আব্দুল্লাহকে গ্রেপ্তারের পর গতকাল মঙ্গলবার তিনি ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। গাড়িটিও জব্দ করেছে পুলিশ।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, হেলেনাকে টেনেহিঁচড়ে হত্যার সময় আব্দুল্লাহ ছাড়াও তিন ছিনতাইকারী গাড়িতে ছিলেন। আব্দুল্লাহ তার সহযোগী ছিনতাইকারীদের সঙ্গে মিলে যে অপকর্ম করছিল, তা মালিক জানতেন না। এই টানা পার্টি বা ছিনতাইকারী চক্রের অপর তিনজনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। আজ বুধবার অভিযান ও তদন্তের ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগ একটি সংবাদ সম্মেলন করবে বলে জানা গেছে।
এদিকে সম্প্রতি এক সপ্তাহের ব্যবধানে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে পুরনো ঢাকার দয়াগঞ্জে ইব্রাহিম ও উত্তরায় আল-আমিন নামে দুই ব্যবসায়ী নিহত হন। এসব খুনের কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে তিন-চারজন ব্যক্তি এবং একটি প্রাইভেটকার সম্পর্কে তথ্য উদ্ঘাটনই তদন্তকারীদের সাফল্য। গত বছরের ২৯ নভেম্বর কলেজগেট থেকে মোহাম্মদপুরে যাওয়ার পথে টানা পার্টির কবলে পড়ে নিহত হন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের (এনআইসিভিডি) চিকিত্সক ফরহাদ আলম। দুই মাসেও ওই চিকিৎসকের মৃত্যুর জন্য দায়ী টানা পার্টির চক্র গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
জানতে চাইলে গতকাল ধানমণ্ডি থানার ওসি আব্দুল লতিফ বলেন, 'টানা পার্টির কবলে পড়ে হেলেনার মৃত্যুর ঘটনার তদন্তে অনেক অগ্রগতি আছে। কাজ চলছে। ব্রিফিং করে অগ্রগতি জানানো হবে।'
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, প্রযুক্তি ও প্রত্যক্ষদর্শীর মাধ্যমে তদন্ত করে পুলিশ ছিনতাই কাজে ব্যবহৃত গাড়িটি শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। গত সোমবার আশুলিয়া থেকে গাড়িটির চালক আব্দুল্লাহকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ সময় টয়োটা এক্সিও ২০০৯ মডেলের সাদা গাড়িটিও জব্দ করা হয়। এই গাড়িটি ভাড়ায় চালাতেন আব্দুল্লাহ। রাতে তার কাছেই গাড়িটি থাকতো। তিনি মালিককে মিথ্যা বলে গাড়িটি তার সহযোগী ছিনতাইকারীদের হাতে তুলে দিতেন। মালিক বিষয়টি জানতেন না। ভাড়ায় অন্যত্র আছেন জানিয়ে পরে মালিককে টাকা দিতেন। গত ২৫ জানায়ারি দিবাগত রাতে কুমিল্লায় ভাড়া নিয়ে গেছেন বলেও জানান। গতকাল ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে জবানবন্দিতে আব্দুল্লাহ তিন ছিনতাইকারীর নাম-পরিচয় জানিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, ঘটনার সময় তিনি গাড়ির ভেতরের আসনে ছিলেন। চালকের আসনে ছিলেন অন্যজন।
পুলিশ সূত্র জানায়, তিন ছিনতাইকারীর তথ্য পাওয়ার পর তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে। এই ছিনতাইকারী গ্রুপটি ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে ছিনতাই করতো।
নিহত হেলেনা ছিলেন গ্রিন লাইফ হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা কর্মী। তার স্বামী মনিরুল ইসলাম মন্টুর সঙ্গে তিনি গ্রমের বাড়ি বরিশালে যান। ফিরে এসে ২৬ জানুয়ারি ভোরে ধানমণ্ডির ৭ নম্বর রাস্তার মাথায় বাস থেকে নামেন। এরপর রাস্তা পার হতে গেলে প্রাইভেটকারের চালকের আসনে বসা টানা পার্টির সদস্য তার ব্যাগ ধরে হ্যাচকা টান দেয়। এতে গাড়ির জানালায় আটকে কিছুটা দূরে গিয়ে পড়ে যান হেলেনা। গাড়িটি তার মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। ঘটনাস্থলে নিহত হেলেনার স্বামী পরে পুলিশকে বর্ণনা দেন।
মনিরুল ইসলাম মন্টু গতকাল মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে বলেন, চোখের সামনে স্ত্রীর সেই মৃত্যুর দৃশ্য আমি ভুলতে পারছি না। পুলিশ বলছে তারা নাকি পেয়ে গেছে। ধরতে পারবে। আসল খুনিদের আমি বিচার চাই।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, ঘটনার পর দুটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজে সাদা ভালো একটি গাড়ির পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখা যায়। সাধারণত ছিনতাইকারীরা পুরনো ভাঙা গাড়ি ব্যবহার করে। ওই দৃশ্য দেখে তখনই ব্যক্তি মালিকানাধীন ভালো গাড়ি ব্যবহার হয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়।
২৬ জানুয়ারি ভোরে হেলেনার মৃত্যুর সময়ই স্বামীবাগ রেললাইনের কাছে দয়াগঞ্জ এলাকায় ছুরিকাঘাতে নিহত হন খুলনার ব্যবসায়ী ইব্রাহিম। আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েও হাসপাতালে একাই গিয়েছিলেন তিনি। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার পরও তার কাছে লক্ষাধিক টাকা ও মোবাইল ফোন পাওয়া যায়। এ কারণে পুলিশ ঘটনাটি নিয়ে সন্দেহ করলেও স্বজনরা দাবি করেছেন, ছিনতাইকারীরাই হত্যা করেছে ইব্রাহিমকে। তার দৃঢ় প্রতিরোধের কারণে টাকা নিতে পারেনি।
অজ্ঞাত খুনির বিরুদ্ধে গেন্ডারিয়া থানায় হত্যা মামলা করে ইব্রাহিমের ভগ্নিপতি আবদুল হক। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, এতদিন হয়ে গেল পুলিশ কিছুই বের করতে পারেনি।'
জানতে চাইলে গেন্ডারিয়া থানার ওসি মিজানুর রহমান বলেন, 'আমরা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণসহ বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে কাজ করছি। ইব্রাহিমের ব্যক্তিগত কোনো বিষয় পাওয়া যায়নি। খুনিরা তিন-চারজন ছিল। তাদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি।'
গত ১ ফেব্রুয়ারি সকালে উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টরে প্রাইভেটকার নিয়ে ওৎ পেতে থাকা ছিনতাইকরীরা ছুরিকাঘাতে হত্যা করে মোবাইল ব্যাকিং বিকাশের বিক্রয়কর্মী আল-আমিনকে। এ সময় লক্ষাধিক টাকাও নিয়ে যায় খুনিরা।
উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি আলী হোসেন বলেন, 'পুরনো একটি গাড়ি নিয়ে ছিনতাই করেছিল চক্রটি। কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। আমরা চেষ্টা করছি।'
অন্যদিকে ২৯ নভেম্বর কর্মস্থল থেকে রিকশায় করে মোহাম্মদপুরের বাসায় যাওয়ার সময় শাহজাহান রোডে মোটরসাইকেলে আসা দুই ছিনতাইকারী ছো-মেরে এনআইসিভিডি চিকিৎসক ফরহাদ আলমের ব্যাগ নিয়ে যায়। এ সময় পড়ে মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়ে নিহত হন ফরহাদ। এ ঘটনায় চিকিৎসকরা বিক্ষোভ মানবন্ধনও করে। গত দুই মাসে মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে বেশ কয়েকজন ছিনতাইকারী গ্রেপ্তার করে র্যাব। সোমবার ওই আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে ফরহাদের খুনি চক্রটি এখনো শনাক্ত হয়নি। মোহাম্মদপুর থানার ওসি জামাল উদ্দিন মীর বলেন, খুনি শনাক্তের চেষ্টা চলছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন