রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধনের শর্ত প্রতিপালন করা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়টি হুমকি, ধমকির মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে শর্ত যাচাই করতে গিয়ে উটকো ঝামেলায় পড়তে হতে পারে, বিনষ্ট হতে পারে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা- এই শঙ্কায় উল্টো পথে চলা শুরু করেছে কমিশন। পুরনো ৪০ রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম তদারকি করার সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিজেদের কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসে এখন কমিশন বলছে, নিবন্ধনের শর্ত পালন করছে কি না কিংবা না করলে তাদের নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিলে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে সব কিছু এলোমেলো হয়ে যেতে পারে। দল এবং ইসিতে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হতে পারে, যার প্রভাব পড়তে পারে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতিতে। বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় এনেই এই সিদ্ধান্ত।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২ এর ৯০ (বি) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নিবন্ধন পেতে হলে কোনো দলের একটি কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও একটি কেন্দ্রীয় কমিটি থাকতে হয়। একইসঙ্গে দেশের অন্তত এক তৃতীয়াংশ জেলায় দলীয় কার্যালয় এবং অন্তত একশটি উপজেলায় দুইশ’ সদস্য থাকতে হয়। যে সদস্যদের আবার সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটার হতে হবে। এই শর্ত পূরণ না করলে কোনো দল নিবন্ধন পাবে না। পরবর্তী যদি এসব তথ্যের কিছু পরিবর্তন হয়ে থাকে, তবে দলগুলো সময় সময় হালনাগাদ তথ্য দেবে বলেই নিবন্ধন নিয়েছে নির্বাচন কমিশন থেকে। কিন্তু ৪০টি দলের মধ্যে অনেক দলেরই বর্তমানে কার্যালয় নেই বলে ইসির পর্যবেক্ষণে এসেছে। তাই এবার সেসব দলের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সংস্থাটি। দলগুলোর হালনাগাদ তথ্য চেয়ে চিঠি দেয়ার আগে কমিশন থেকে শর্ত প্রতিপালন না করা দলের নিবন্ধন বাতিলেরও হুমকি দেয়া হয়। হুমকি-ধমকির মধ্যে সীমাবদ্ধ কমিশন এখন পুরনো দলগুলোর বিষয়ে নমনীয়তা দেখিয়ে নতুন ৭৬ দলের দিকে মনোযোগ দিয়েছে। শিগগিরই নতুন আবেদন করা দলগুলোর তথ্য খতিয়ে দেখতে বৈঠকে বসছে অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বাধীন কমিটি।
এ বিষয়ে কমিশনের অতিরিক্ত সচিব মো. মোখলেসুর রহমান জানান, পুরনো দলের বিষয়ে কোনো কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আগামী নির্বাচনের আগে নিবন্ধনের শর্ত ঘাটতি থাকার কারণে ওই দলের নিবন্ধন বাতিলের মতো সিদ্ধান্ত নেয়া কমিশনের জন্য সমীচীন হবে না। তবে নতুন ৭৬ দলের তথ্য যাচাই-বাছাই করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এই কমিটির একটি বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পুরনো দলগুলো নিবন্ধনের শর্ত পালন করে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হালনাগাদ তথ্য চেয়ে পত্র পাঠায়। প্রথমে ১৫ কার্যদিবস সময়ে ৪০ দলের মধ্যে ২৮টি যথাসময়ে তথ্য দেয়। জমা না দেয়া ১২টি দলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে কী না ইসির এমন দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যেই আরো দুটি দল তথ্য জমা দেয়। বাকি ১০ দলকে ৩০ কার্যদিবস সময় দিলে এ সময়ের মধ্যে ৭টি দল তথ্য জমা দেয়। তবে সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন ও বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন ইসিকে কোনো তথ্য দেয়নি।
এর আগে বিদায়ী রকিব কমিশন ৪০ নিবন্ধিত দলের তথ্য চেয়ে চিঠি দিলেও তা আমলে নেয়নি দলগুলো। ইসির পরিসংখ্যান বলছে, ইসির মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকায় রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তারা ব্যর্থ হয়। বলা যায়, শুধুমাত্র সাংবিধানিক সংশ্লিষ্টদের কার্যক্রম হুমকি-ধমকির মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে যায়। কমিশনের এই দুর্বলতার সুযোগে দলগুলো দিনে দিনে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠছে। কারণ ৪০ দলের মধ্যে দু’দফা সময় দিয়েও সব দল তথ্য দেয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইসির নিবন্ধন শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, পুরনো দলের অধিকাংশই তথ্য দিলেও তাদের মাঠ অফিস, দলীয় কার্যক্রম এবং নিবন্ধনের সব শর্ত পালন করছে কি না সে বিষয়ে কমিশনে নথি উত্থাপনেও সংশ্লিষ্ট শাখা ভয় পাচ্ছে। কারণ কমিশনের নির্দেশনা ছাড়া নথি উত্থাপনের কারণে কমিশনের নীতি-নির্ধারকদের বিরাগভাজন কিংবা রোষানলে না পড়েন ওই ভয়ে রয়েছেন তারা।
এদিকে, পুরনো দলের মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি বাদে অধিকাংশ দলের দেয়া তথ্যের মধ্যে নানা ত্রুটি দেখা গেছে। প্রত্যেকে দায়সারাভাবে প্রতিবেদন দিয়েছেন। এমনিই একটি দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) আগামী ২০২০ সালের মধ্যে দলে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে বলেছে, তার দলের পক্ষে নারী সদস্য পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্য দলগুলোর চিত্র প্রায় একই। এতো ত্রুটির পরও কমিশন তাদের প্রাপ্তি অনেক বলে দাবি করেছেন। নিবন্ধন শাখার অপর একজন বলেন, দলগুলো বার্ষিক অডিট রিপোর্ট জমা দিচ্ছে এবং এবার হালনাগাদ তথ্য চাইলে জমা দিয়েছে। তাই দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা চলছে তা ধরে নেয়া যায়। ফলে মাঠ পর্যায়ে অফিস কিংবা কার্যক্রম চলছে কি না তা নতুন করে পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন নেই।
উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে নিবন্ধন প্রথা চালুর পর এ পর্যন্ত ৪২টি দল নিবন্ধিত হয়েছে। এর মধ্যে স্থায়ী সংশোধিত গঠনতন্ত্র দিতে না পারায় ২০০৯ সালে ফ্রিডম পার্টির নিবন্ধন বাতিল করে ইসি। আর আদালতের আদেশে ২০১৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ হয়। নিবন্ধন কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনের আগে নতুন দলকে নিবন্ধিত করতে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে সাবেক কাজী রকিবউদ্দিন কমিশন। তাদের সময়ে ৪৩টি নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে। এর মধ্যে ৪১টিই দলই নির্বাচন কমিশনের কাছে নিজেদের ‘যোগ্যতার’ প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়।
মানবকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন