দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যতদিন থাকবে ততদিন তার প্রতি মানুষের সিম্প্যাথি বা সমবেদনা বাড়তে থাকবে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নূহ উল আলম লেনিন। এজন্য খালেদা জিয়ার কারাবন্দির মেয়াদ বাড়ুক এটা আওয়ামী লীগ চায় না। কারণ এতে জনগণের সিম্প্যাথি খালেদা জিয়া ও বিএনপির প্রতি চলে যাবে। তবে সবকিছু আইন অনুযায়ী চলবে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের এই নেতা।
শনিবার রাতে সময় টেলিভিশনের একটি টক শোতে অংশ নিয়ে লেনিন এসব কথা বলেন। ‘সম্পাদকীয়’ নামের এই টক শোতে তার সঙ্গে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক এবং বাসদের সাধারণ সম্পাদক কমরেড খালেকুজ্জামান।
লেনিন বলেন, ‘খালেদা জেলে থাকলে আমি মনে করি না আমরা খুব খুশি, আমাদের খুব লাভ। বরং তিনি জেলে আছেন মানবিক কারণে তার প্রতি মানুষের সিম্প্যাথি রয়েছে। তাহলে তিনি যতদিন জেলে থাকবেন ততদিন সিম্প্যাথি বাড়তে থাকবে। আওয়ামী লীগ এটা চায় না বিএনপির প্রতি মানুষের সিম্প্যাথি বাড়ুক এবং এর ফলে মানুষ বিএনপিপন্থী হোক।’
আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ চায় আইনের শাসন। আমরা চাই দণ্ড দেয়া সত্ত্বেও তারা যেন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে না যায়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে গেলে এতে দল-জনগণ কারও লাভ নেই। এজন্য বিএনপির সামনে নির্বাচনে যাওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প আমি দেখছি না।’
খালেদা জিয়াকে ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না দলটির নেতাদের এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে লেনিন বলেন, ‘বিএনপি যেহেতু একবার নির্বাচন বয়কট করেছিল এবং এতে তারা বড় ভুল করেছে, এর খেসারত বিএনপিকে দিতে হয়েছে, জাতিকেও এক অর্থে দিতে হয়েছে। তারা পার্লামেন্টে না থাকায় ক্ষতি হয়েছে গণতন্ত্রের। তারা যে কথাগুলো এখন বাইরে বলছে তা পার্লামেন্টে বললে প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হতো। সেজন্য তাদের ভুলের পুনরাবৃত্তি যেন না হয় সে ব্যাপারে আমরা আগে থেকে তাদের সতর্ক করছি।’
আন্দোলন করে বিএনপি সফল হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘২০১৪ সালে নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি বিএনপি। ২০১৮ সালের বিএনপি আরও দুর্বল। রাজনীতিতে সবচেয়ে নিরীহ কর্মসূচি গণস্বাক্ষর। সেটা আমরাও করেছি, শেখ হাসিনা কারাগারে থাকাকালে। আন্দোলনে এটা হলো নিরামিষ পদ, যদিও আইনসম্মত। সেই নিরামিষ পদের আন্দোলন বিএনপি এখন করছে।’ খালেদা জিয়ার দণ্ডের ইস্যুতে জনগণকে সংঘবদ্ধ করে আন্দোলন করা এবং সফলতা পাওয়া বিএনপির পক্ষে সম্ভব হবে না বলে মনে করেন রাজনীতির এই গবেষক।
খালেদা জিয়ার মামলার রায়ের কপি দেয়ার ক্ষেত্রে দেরির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই কপি নির্বাহী বিভাগ দেবে না, আওয়ামী লীগ অফিস দেবে না, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ও দেবে না। দেবে বিচার বিভাগ। এ ব্যাপারে কোনো অভিযোগ থাকলে বিএনপি আইনি প্রক্রিয়ায়ই এর মোকাবেলা করতে পারে। প্রয়োজনে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে। এটা না করে পুরো প্রক্রিয়াকে তারা প্রশ্নবিদ্ধ করছে।’
‘বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ আছে, তবে...’
খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ায় বিএনপি কি বেকায়দায়? এমন প্রশ্নে আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, ‘বিএনপি রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় এতে কোনো সন্দেহ নেই। মূলত ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকেই বিএনপি বেকায়দায়। তারা আর নিজেদের উদ্ধার করতে পারেনি। তবে বিএনপির সামনে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ আছে। কিন্তু তারা কতটুকু পারবে সেটা বলা মুশকিল।’
বিএনপি কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে এর প্রক্রিয়া উল্লেখ করতে গিয়ে রাজনীতির এই বিশ্লেষক বলেন, ‘বিএনপিকে জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি দিতে হবে। ঐতিহাসিক ছয় দফার মতো কিছু দফা দিয়ে জনগণকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। নিজেদের অতীতের ভুল-ত্রুটি স্বীকার করে জনগণের কাছে প্রমাণ করতে হবে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি তাদের আছে।’
বেকায়দায় থেকেও ঘুরে দাঁড়ানো যায় এ ব্যাপারে তিনি একটি উদাহরণ দেন। তিনি বলেন, সোহরাওয়ার্দীর ইন্তেকালের পর আওয়ামী লীগের হাল ধরেন শেখ মুজিবুর রহমান। অনেকের ধারণা ছিল আওয়ামী লীগ দুর্বল হয়ে পড়বে, আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু দেখা গেল উল্টোটা। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়িয়েছে, ছয় দফার মাধ্যমে জনগণকে সম্পৃক্ত করেছে এবং তার হাত ধরে দেশের স্বাধীনতা এসেছে। এটা সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর মধ্যে একটা আকর্ষণ শক্তি ছিল, যা দ্বারা তিনি জনগণকে আকর্ষিত করেছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতি আর স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। নানান দিক থেকে দেখলে দেখব তা অস্বাভাবিক। একটি মামলার রায়কে কেন্দ্র করে নির্বাচনসংক্রান্ত বক্তব্য আসা এটা স্বাভাবিক রাজনৈতিক অবস্থার লক্ষণ নয়। তাছাড়া আইনের শাসনেরও লক্ষণ না ‘
আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, ‘খালেদাকে ছাড়া নির্বাচনে যাবো না এটা বিএনপির পক্ষ থেকে তারা বলতে পারে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এতটা রেসপন্স না করলেই বোধহয় ভালো হতো।’
রাজনীতির এই বিশ্লেষক বলেন, ‘একটি রায় নিয়ে গোটা জাতি যে বিতর্কে পড়ে গেছে এটা কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক বিতর্ক নয়। আমাদের অন্য বিষয়ের দিকেও মনোযোগী হওয়া উচিত যদি বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্ররূপে আশা করি। খালেদা জিয়া কারারুদ্ধ হয়েছেন, যেকোনো মানুষ কারাগারে গেলে সেটা তো কষ্টকর ব্যাপার। আমাদের মানবিক সহানুভূতি তার প্রতি আছে। কিন্তু রাজনৈতিক বিষয় তো রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করতে হবে। দেশের মানুষ স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রয়োগ করবেন সেটাই আমরা চাই।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে কমরেড খালেকুজ্জামান বলেন, ‘বর্তমান অবস্থা বুর্জোয়া রাজনীতি তার দেউলিয়াত্ব ও অসুস্থ রাজনীতিকে নির্দেশ করে। জনগণকে আমরা বলছি ক্ষমতার মালিক। অথচ জনগণকে ক্ষমতার বৃত্ত থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছি আমরা। দেশের জনজীবনের সমস্যা আলোচনায় নেই। এগুলো নিয়ে যখন মানুষের মধ্যে হাহাকার চলছে সেগুলো নিয়ে আমরা আলোচনার সুযোগ পাচ্ছি না। ক্ষমতায় যারা আছে তারা ছাড়তে চায় না, যারা বাইরে আছে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তারা মরিয়া।’
এই বাম রাজনীতিক মনে করেন, মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে আর সমাজের পচন রাজনীতি থেকে। এখনকার রাজনীতি পচন শুরু হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
(ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন