গত ছয় মাসে বাংলাদেশের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, একজন সাংবাদিক ও সাবেক এক কূটনীতিবিদকে গুম করার ঘটনা সরকারের সমালোচকদের মধ্যে নতুন করে ভীতির জন্ম দিয়েছে। নির্বাচনী বছরে এ ধরনের গুম ও ভীতি সৃষ্টির জন্য রাষ্ট্রীয় সংস্থাকেই প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে ধরা হচ্ছে।এ নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এশিয়াবিষয়ক গণমাধ্যম এশিয়া টাইমস।জাতিসংঘের মতে, কাউকে গুম করা মানবাধিকারের লঙ্ঘন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ। যদিও বাংলাদেশে তা এখন প্রায়ই ঘটে চলেছে। ইতিহাসবিদ ড. আনোয়ার হোসেনের মতে, বেশির ভাগ গুম রাষ্ট্রীয় সহায়তায় হচ্ছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। আর সরকারও চায় না এসব নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন হোক।
বাংলাদেশের একটি দৈনিক পত্রিকার সাবেক এই প্রধান সম্পাদক এশিয়া টাইমসকে জানান, তিনি মনে করেন, গণমাধ্যমে গুমের ঘটনা প্রকাশের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে যেমন বাধা আছে, তেমনি গণমাধ্যমগুলোও আত্মনিরোধের (সেল্ফ সেন্সরশিপ) পথ বেছে নিয়েছে। তার ভাষায়, ‘গণমাধ্যম এখানে আর যাই হোক, স্বাধীন নয়। এ কারণেই আমি পদত্যাগ করেছিলাম।’বাংলাদেশে গত ছয় মাসে ১৫টি গুমের ঘটনা জানা গেছে। যদিও বেশিরভাগ লোক ফিরে এসেছে। কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য না হওয়ায় ওই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সাংবাদিক ও সাবেক কূটনীতিবিদের গুম সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছিল।
এশিয়া টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মুবাশশার হাসান জঙ্গিবাদ নিয়ে গবেষণা করেন। সাংবাদিক উৎপল দাস বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে রিপোর্ট করতেন এবং সাবেক কূটনীতিবিদ মারুফ জামান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন সমালোচক। ফেসবুকেও তিনি সরকারের বিরুদ্ধে লেখালেখি করতেন।মুবাশশার ও উৎপলকে যথাক্রমে ৪৪ ও ৭১ দিনের জন্য আটকে রাখা হয়েছিল। পরে চোখ বেঁধে তাদের রাস্তায় ফেলে যাওয়া হয়। মারুফ জামান এখনো নিরুদ্দেশ।তার মেয়ে শবনম জামান জানান, প্রথম দিকে গণমাধ্যমগুলো তার বাবার গুমের ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন করলেও গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আর কিছুই প্রকাশ করেনি।বাংলাদেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যমই গুমের ঘটনা ঘটলে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। কিন্তু কড়া ভাষায় সমালোচনা করতে পারে না। গুম নিয়ে প্রতিবেদন করায় ভারতীয় একটি গণমাধ্যমের ওয়েবসাইট বাংলাদেশে বন্ধ রেখেছে সরকার।
বিদেশী গণমাধ্যমের ওয়েবসাইট বন্ধের ঘটনা বাংলাদেশে এই প্রথম নয়। ২০১৭ সালের মে মাসে সিনিয়র এক র্যাব কর্মকর্তাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল সুইডেনের একটি ওয়েবসাইট। প্রতিবেদনটিতে ওই কর্মকর্তা স্বীকার করেন, তার বাহিনী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।প্রতিবেদনটিতে দাবি করা হয়, বাংলাদেশ সরকার সব সময়ই গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু জানান, সারা দেশের গণমাধ্যমগুলোই স্বাধীনতা ভোগ করছে। সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করছে না। যদিও গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬তম।এর আগে গুম নিয়ে বাংলাদেশে বেশ কয়েক বছর ধরে তদন্ত করেছেন ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান। এ নিয়ে ‘উই ডোন্ট হ্যাভ হিম’ শিরোনামে ৮২ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদনও লিখেছেন তিনি।
এতে বলা হয়েছে, ২০১৩ সাল থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কয়েকশ লোককে অবৈধভাবে আটক করেছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালেই ৯০ জনকে গুম করা হয়েছে।ওই প্রতিবেদনের পর সম্প্রতি বার্গম্যানের ভিসা নবায়নে অস্বীকৃতি জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। যুক্তরাজ্য থেকে এশিয়া টাইমসে তিনি জানান, সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করলে তার মূল্য দিতে হয় বাংলাদেশী গণমাধ্যমগুলোকে।রাজনৈতিক বিশ্লেষক আফসান চৌধুরী জানান, যারা গুম থেকে ফিরে আসে, অপহরণ বিষয়ে তারাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারতো। কিন্তু ফিরে আসার পর কী ঘটেছিল, তা জানাতে তারা ‘অস্বাভাবিকভাবেই নিশ্চুপ’ হয়ে যান।
এদিকে গুমের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধ ঠেকাতে বাংলাদেশে নেই নির্দিষ্ট কোনো আইন। ২০০৬ সালে গুমের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে একটি প্রস্তবনা গৃহীত হয়। এতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র বা যে-ই হোক, গুমের ক্ষেত্রে তার বিচার করতে হবে। তবে বাংলাদেশ এখনো ওই প্রস্তাবনায় স্বাক্ষর করেনি।এ বিষয়ে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিও) দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলী বলেন, ‘মনে হচ্ছে বাংলাদেশ সরকার গুম সমস্যা সমাধানে আগ্রহী নয়।’গত জুলাইতে এইচআরডব্লিও বার্গম্যানের প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল একে ‘মানহানিকর প্রচারণা’ বলে উড়িয়ে দেন। এতে হতাশ হয় ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন