জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়ে দেয়া রায়ের অনুলিপি পেতে বিলম্বের জন্য তার আইনজীবীদের দায়ী করেছেন বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেছেন, রায়ের পর পর কপি পেতে আবেদন না করে নামিদামি আইনজীবীরা যে এমন ‘মূর্খতার’ পরিচয় দেবেন, সেটা তিনি ভাবতে পারেননি।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী কাজ করছেন দেশের চিকিৎসা খাতে গুণগত পরিবর্তনের জন্য। প্রতিষ্ঠা করেছেন গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র। কিন্তু হাল আমলে বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী হিসেবে তার পরিচয় প্রাধান্য পেয়েছে।
এক সময়ের চীনপন্থী বাম নেতা এখন ক্ষণে ক্ষণে বিএনপিকে বুদ্ধি পরামর্শ দেন। কী করলে দলের ভালো হবে, সে বিষয়ে নানা সময় পত্রিকায় খোলা চিঠিও লিখেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে। দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়ার সাজার পর বিএনপি যেসব বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে বৈঠক করেছে, তাদের একজন জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
ঢাকাটাইমসের সঙ্গেও মুখোমুখি হয়েছিলেন এই বুদ্ধিজীবী। খালেদা জিয়ার রায় পরবর্তী নানা বিষয়ে দিয়েছেন খোলামেলা মতামত।
খালেদা জিয়ার শাস্তির প্রতিবাদে বিএনপির শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে কীভাবে দেখছেন?
বিএনপির চেয়ারপারসন কিন্তু জেল যাওয়ার আগেই বলেছেন শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কথা। আন্দোলনে যাতে কোন অনুপ্রবেশ না ঘটে, সে জন্য শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কথা বলেছেন। অতীতে দেখা গেছে ২০১৪-১৫ সলে গাড়ি ভাঙার সময়, হয়তো তারা দুই একটা ভেঙেছে। তারা যে ভাঙেনি আমি সেটা বলব না। কিন্তু সরকারি দল যে অনেক ভেঙেছে। চৌদ্দগ্রামে যেটা, শাহবাগের সামনে যেটা। এটাতো প্রমাণিত এটা ওনারা (সরকারি দল) করেছে। সুতরাং সেটার কথা খালেদা জিয়া বলেই গেছেন।
আমি সব সময় বলি খারাপ জিনিসগুলোর একটা ভালো দিক থাকে। খালেদা জিয়াকে জেলে নেওয়ার ভালো দিক আছে। সেটা ওনার পার্টির মধ্যে এবং ওনার আত্মোপলব্ধি হবে। এখন বিএনপিকে রাস্তায় নামতে হচ্ছে, জনগণকে সাথে নিতে হচ্ছে এবং তারা দেখতে পাচ্ছে ব্যাপক জনগণ তাদের সাথে আছে। এই যে ব্যাপক জনগণ সাথে পাওয়ার মূল কারণ সরকারের দুর্নীতি, দুঃশাসন এবং ভুল পথে দেশ পরিচালনা করা। এই সমস্ত কারণে জনগণের বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। অন্যদিকে ভালো সাইটা হলো সরকারেও জ্ঞান চক্ষু খুলে যাবে।
সরকারি দল তো বিএনপির কর্মসূচি নিয়ে কটাক্ষ করছে...
খালেদার সাজা দেওয়ার পরে সরকার যা ভেবেছিল তা ঘটে নাই। এই ইস্যুটাকে জনগণ যেভাবে স্বতঃস্ফুর্তভাবে নিয়েছে। এই যে মামলাতে খালেদা জিয়া নিশ্চই চুরি করেন নাই। এই মামলাতে ওনি জেলে আছেন। ওনার জন্য শিক্ষণীয় হলো যে, কত নিরপরাধ লোক জেলে যায়। ওনার আত্মোপলব্ধি হবে ওনি যদি কখনও ক্ষমতায় যায়, তবে নিরপরাধ লোককে জেলে পাঠাবেন না। আক্তারুজ্জামান যদি নিরপেক্ষ লোক হতেন তবে এই মামলাতে খালেদা জিয়ার শাস্তি হতো না।
কেন এমন কথা বলছেন?
খালেদা জিয়ার মামলায় অর্থ আত্মসাৎ প্রমাণ হয়নি, প্রমাণ হয়েছে ক্ষমতার অপব্যবহার। ৪০৯ ধারায় তারা সাজা হয়েছে। ১৯৭৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের প্রিয় মুজিব ভাই গণস্বাস্থ্য ট্রাস্টকে ২৩ একর জায়গা দিয়েছিলেন, সেটাও তো ক্ষমতার অপব্যবহার। গণস্বাস্থ্য ট্রাস্টকে দিয়েছিলেন ভূমি দখল করে, ওনি মনে করেছিলেন জাফরুল্লাহ একটা স্বপ্ন দেখাচ্ছে, একটা ভালো কাজ করতে চায়, তাকে সাহায্য করা। এই যে আজকের প্রধানমন্ত্রী প্রতিদিন সাহায্য করছেন, এই যে সিদ্দিকুর রহমান চোখ ঠিক করার জন্য বিদেশে যাওয়ার পয়সা দিছেন। এগুলো কি ক্ষমতার অপব্যবহার বলবেন?
আপনি তো সরকারের কট্ট সমালোচক। আপনার বক্তব্য সরকারি দল কেন মানবে?
না না, আমি প্রধানমন্ত্রীর অনেক কাজে এপ্রিসিয়েট (প্রশংসা) করি। প্রধানমন্ত্রীর একটা সমস্যা যেটা আমি দেখি সেটা ওনার পিতা মাতা সবাইকে আমরা মেরে ফেলেছি। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে ওনার সবাইকে মেরে ফেলেছি। সেই ওনাকে আমরা ক্ষমতায় বসিয়েছি, ওনি ক্ষমতায় এসে কী বলেছিলেন? আমারা বাবা, মাকে মেরে ফেলেছে তোমরা কেউ কাঁদো নাই, আমি সবাইকে কাঁদিয়ে ছাড়ব। শাস্তি দেওয়া উদ্দেশ্য না, ওনি দুঃখের থেকে বলেছেন। সেই জন্যই খালেদা জিয়া বলেছেন ওনি কোন জিঘাংসা করবেন না।
জিঘাংসার প্রসঙ্গ কেন আসছে?
পরিবর্তনে আওয়ামী লীগ ভয় পাচ্ছে। তারাও বুঝতে পারছে এই বুঝি পরিবর্তন হয়ে গেল। পরিবর্তন হয়ে গেলে এরা যদি জিঘাংসা নেয়। আজকে বিএনপির ২০ হাজার লোক জেলে ছিল, তারা কয়েক লাখ মামলার আসামি হয়েছে। হাসিনার মনে যে রকম জিঘাংসা হয়েছে, এদের মনেও তো জিঘাংসা তৈরি হয়েছে। বিএনপি যদি ক্ষমাতায় আসে, তারা যদি প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করে, দেশ অরাজকতা হবে।
সেই জন্য খালেদা জিয়ার জেলে থেকে বেরিয়ে এসে ওনি খোলা মনে যদি ঘোষণা দেন যে তিনি প্রতিহিংসার রাজনীতি করবেন না সেটা ভালো হবে।
আপনি বলছেন বিএনপির আন্দোলন সফল, ক্ষমতাসীন দল তো বলছে ব্যর্থ...
ওবায়দুল কাদের মাঝেমধ্যে ভালো কথা বলে। তবে তিনি কিন্তু এই বার (২০০৮ সালের নির্বাচন) ছাড়া আর কখনও এমপি হয় নাই। এই প্রথমবার তিনি নির্বাচিত এমপি। সে বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনেও তিন তিনবার হেরেছেন। দুই বার মান্নার সাথে, একবার আক্তারুজ্জামানের সাথে। তবে আমার হিসেবে সে ভালো ছিল। হয়কি যখন প্রণব মুখার্জি এসে বুদ্ধি দেয়, সুষমা স্বরাজ এসে বুদ্ধি দেয়, তখন সে নোয়াখালীর কথা ভুলে গিয়ে দিল্লির বুদ্ধির দিকে ঝুঁকে যায়। এটাই হয়েছে সমস্যা। তা না হলে আন্দোলনকে ব্যর্থ বলার কোন কারণ নেই।
আওয়ামী লীগও আশ্চর্য হয়ে গেছে যে বিএনপি এই লাইনে কীভাবে গেল? তারা জামায়াতের কথা বলে মারপিট করত, সেটা করতে পারে নাই। আর এটা সারা পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়ার রায়ের সার্টিফায়েড কপি দেরিতে পাওয়ার পেছনে কাদের ব্যর্থতা দেখছেন?
এটা দুইটা কারণে হয়েছে, একটা হলো বিএনপির আইনজীবিদের মূর্খতা, আমি আশ্চর্য হয়েছি। বিএনপির এতো বড় বড় আইনজীবী আছেন, আমরাও এসব মামলা ফেস করেছি। আইনজীবীরা বলত এক মিনিটও দেরি হয় না যেন। সাজা হলেই বলত, স্যার কাগজটা দেন ওপরের কোর্টে যাব। সঙ্গে সঙ্গে আমরা জেলা কোর্টে যেতাম, বিকালে জামিন হতো। এটা শেখ মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনীর মধ্যেই আছে। সকালে ম্যাজিস্ট্রেট শাস্তি দিয়েছে, বিকালে জেলা জজ জামিন দিয়েছে।
সরকারের চতুরতা আছেই, বিএনপিকে আরও বেশি সতর্ক হতে হতো। কারণ বৃহস্পতিবার মানেই তিন দিন আটকাতে চাচ্ছে। আমিও খালেদা জিয়াকে বলেছিলাম আপনাকে হয়তো তিন চার দিন জেলে থাকতে হতে পারে। আমি ভাবতে পারি নাই বিএনপির আইনজীবীরা এতোটা বেকুব। তাদের প্রস্তুতিটা আমার কাছে একটু কষ্টদায়ক মনে হয়েছে। সার্টিফায়েড কপি দেরি হওয়ার পেছনে বিএনপির আইনজীবীদের ব্যর্থতাই দায়ী। নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছেন বিএনপির আইনজীবীরা।
খালেদা জিয়াকে পুরনো কারাগারে রাখার বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
সরকারের পূর্ব প্রস্তুতি দেখেই বলা যায় এটা পরিকল্পিত। সেজন্য তারা আগে থেকে বলেছেন খালেদা জিয়ার শাস্তি হবে। জেলার আগে থেকে কারাগার পরিচ্ছন্ন করেছেন, তার মানে উপর থেকে বলেছে ওটা পরিস্কার করে রাখ। তবে এক হিসেবে খালেদা জিয়া আনন্দিত হতে পারেন যে শেখ মুজিব যে জেলে ছিলেন, সেই জেলেই তিনি আছেন। এটা ওনার জন্য শান্তনার বিষয় যদি থাকে।
খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পরে তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারস করায় দলে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, আপনি কী জানেন?
এটা ভুল কথা। বিএনপির মধ্যে তারেক রহমান অনেক জনপ্রিয়। তার অতীতের অনেক দোষের কথা আছে। সে নাকি ভালো ব্যাবহার করে নাই, সিনিয়রদের সাথে নাকি দুর্বব্যবহার করেছেন। এরশাদ সাহেবের সাথে দুর্বব্যবহার করেছে। এর কারণটা হলো কি- তাকে তারা রাজার ছেলে বানায়া ফেলেছে। বিএনপির লোকজনেরা আপনে আপনে করে মাথায় তুলে ফেলছেন।
তাছাড়া তারেক জিয়া ইজ এ নাইস পারসন। আমি তো তার কখনও খারাপ দেখি নাই। আমি বসার আগে কোন দিন চেয়ারে বসে নাই। আমি বললে সে বসত। ওর দুর্বব্যহারের জন্য ও (তারেক) যতটা না দায়ী, বিএনপির সিনিয়র নেতারা বেশি দায়ী। আমার মতে সে যদি সময় পায় তবে সে ভালো পলিটিক্যাল লিডার হবে।
আপনি বিএনপিকে চলমান পরিস্থিতিতে কী পরামর্শ দিবেন?
এই পরিস্থিতিতে বিএনপিকে প্রথম পরামর্শ যে পার্টি অফিসে, বাড়িতে সর্বক্ষেত্রে যে তিনটা ছবি আছে, জিয়াউর রহমান, খালেদা, তারেক। সেটার ওপরে এক নম্বরে ভাসানীর ছবিটা বসিয়ে দেবে।
বিএনপিকে আরেকটা উপদেশ হবে, দেশের কেন্দ্রীকতা ছেড়ে দিতে হবে। মস্কো তো টিকে নাই, কেন্দ্রীকতার জন্যে টিকে নাই। ইসলামাবাদ টিকে নাই, শাসন তো ইসলামাবাদ থেকে হতো টিকে নাই। আমাদের ঢাকাকেন্দ্রীক শাসনও টিকবে না। আজকে বাংলাদেশকে অবশ্যই শেখ মুজিবুর রহমানের একটা ধারা অনুসরন করতে হবে। খালেদা জিয়াকেও ওইটা করতে হবে, বাংলাদেশকে ১০টা ২০টা বা ৬৫টা স্টেটে ভাগ করতে হবে। তাহলে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হবে।
এখন আমলাদের হাতে ক্ষমতা দিলে যেদিকে বাতাস বয় সে দিকে পাল তুলে দেয়। তারা ন্যয় কথা বলে না, সত্য কথা বলে না দুই চারজন ছাড়া। সেক্ষেত্রে খালেদাকে এই সংস্কারগুলো করতে হবে।
তাছাড়া ওনার (খালেদা জিয়া) পার্টির মধ্যে গণতন্ত্র আনতে হবে। ওনি মিটিং করে টাকা বরবাত না করে, কাউন্সিল মিটিং করতে হবে ওনাকে। কাউন্সিল মিটিং করে তাদের মতামত নিতে হবে। তার স্ট্যান্ডিং কমিটিতে ওনি ছাড়া আর কোন মহিলা মেম্বার নাই। সেখানে মহিলা সদস্য বাড়াতে হবে। কাউকে না পেলে ওনার ছেলের বউকেই নিক।
দ্বিতীয়ত বলব. কৃষক শ্রমিকরা আর্মির দরে রেশন পাবে, এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশ বাহিনীতে সংস্কার দরকার। কমপক্ষে বিএ পাসের নীচে কোন পুলিশ হবে না। কনস্টেবল হতে হলে তোমাকে বিএ পাস হতে হবে এবং এক বছর আইনের ট্রেনিং নিতে হবে। আইন পড়লে তারা যে কোন কাজ করতে দ্বিধা করত। এখন পুলিশ হয়েছে ডাকাত বাহিনী, এরা পয়সা লুটপাট করে।
ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন