স্কুল জীবনে ফেব্রুয়ারি মাস এলেই অপেক্ষায় থাকতাম একুশ তারিখের। ওইদিন শহীদ বেদিতে ফুল দিতে হবে। খুব ভোরে। সবার আগে। ভোরে না গেলে সবার আগে ফুল দেওয়া যায় না। আমাদের স্কুলের মাঠের কোণায় একটা শহীদ মিনার ছিল। সারা বছর এর কোনো কদর না হলেও একুশে ফেব্রুয়ারির আগে ধোয়া মোছা করে নতুন রঙ করা হতো। আবার সারা বছর অনাদরে মলিন হতো।
একুশে ফেব্রুয়ারির আগের রাতে চলতো ফুল সংগ্রহ। বন্ধুরা মিলে কার কার বাড়িতে বাগান ছিল, আগেই মুখেমুখে তালিকা করে ফেলতাম। সন্ধ্যার পর শুরু হতো ফুল সংগ্রহের অভিযান। চুপিসারে। বাড়ির মালিক যেন টের না পায়। দু-একবার ধরা পড়ার ঘটনাও ঘটেছে। তখন জুতো-স্যান্ডেল রেখে দে দৌড়। আর কে পায়? পরদিন ভোরে গেলে দেখা যেতো জুতো জোড়া একেকটা একেক দিকে পড়ে আছে। আবার অনেক সময় এক পাটি পেয়েছি, অন্যটি নিঁখোজ। এক পাটি জুতো পরে খোড়াতে খোড়াতে নিখোঁজ পাটির খোঁজ করতে করতে বাসায় ফিরতাম।
একবার ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে নানু বাড়িতে গেলাম। বগুড়ায়। কথা ছিল একুশে ফেব্রুয়ারির আগে ফিরে আসবো। মা-ও কথা দিয়েছিলেন, একুশ তারিখের আগেই ফিরবেন। কিন্তু পরে তিনি দেওয়া কথা ভুলে গেলেন। আমার ভেতরে উথাল-তাল শুরু হলো। এবার একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া হবে না! বন্ধুরা দেবে। আমিই পারবো না!
মন খারাপের রেশ রয়ে গেল একুশে ফেব্রুয়ারির সকাল পর্যন্ত। নানু বাড়ির আশপাশে কলার বাগান। সামনে বিস্তৃর ফসলের মাঠ। ওইগ্রামে বড় কোনো স্কুল নেই। যাও আছে শহীদ মিনার নেই। অনেক দূরের স্কুলে শহীদ মিনার। কম করে হলেও কিলো পাঁচেক পথ। এত পথ পারি দিয়ে একা একা যাবো সেই সাহসও হচ্ছিল। কী করি? আগানে-বাগানে হেঁটে বেড়াচ্ছি। হাতে একটা বাঁশের কঞ্চি। মন খারাপের জেরে কঞ্চি দিয়ে লতায়-পাতায় আঘাত করছি। আঘাতে আঘাতে কলা গাছের পাতাগুলো ছিঁড়ে ঝুলে পড়ছে।
হঠাৎ বুদ্ধি এলো মাথায়। বাড়ি থেকে দৌড়ে গিয়ে দা এনে লম্বা একটা কলা গাছ কাটলাম। নানু বাড়ির সমবয়সী দু-একজন বন্ধুও জুটে গেল। সবাই ধরাধরি করে গাছ কাঁধে নিয়ে ফসলের মাঠে নিয়ে এলাম। শুরু হলো শহীদ মিনার বানানোর কাজ। গাছটাকে তিন ভাগ করে দাঁড়িয়ে গেল তিনটি স্তম্ভ। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে একটির সঙ্গে আরেকটি এঁটে দিলাম। স্তম্ভ হলো, কিন্তু পেছনের সূর্য? বন্ধুদের একজন বলল, বুদ্ধি পাইছি!
আমি বললাম, কী?
ঘুড্ডি!
এক টাকা দিয়ে তখন কাগজের ঘুড়ি পাওয়া যেতো। ছেলেটি দৌড়ে গিয়ে দোকান থেকে একটা ঘুড়ি কিনে আনলো। সমস্যা হলো টকটকে লাল পাওয়া গেল না। গাঢ় গোলাপি। সেই ঘুড়িটার লেজ-পাখা ছেঁটে দিয়ে তৈরি হলো পঞ্চকোণের সূর্য। লাগানো হলো কলা গাছের খুঁটিগুলোর পেছনে। মাটি দিয়ে তৈরি হলো বেদী।
তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। পাড়ার ছেলেপুলেরা ভিড় করল শহীদ মিনার দেখতে। এবার ফুল দেওয়ার পালা। কে কার আগে ফুল দেবে, সেই প্রতিযোগিতা শুরু হলো। যে যার মতো ছুটে গেল ফুলের সন্ধানে। কেউ ফিরলো গাদা ফুল নিয়ে। কেউ টগর, কেউ ভাট, কেউ আকন্দ ফুলের মালা বানিয়ে বেদীতে সম্মান জানালো। কারো আবার তর সইছিল না। শিমুলের ডাল ভেঙে সোজা ছুঁটে এলো শহীদ মিনারে। ফুলে ফুলে ভরে গেল বেদি। সবাই মিলে সেদিন গেয়েছিলাম, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। আমি কি ভুলিতে পারি।’ সন্ধ্যার আগমণে দিনের আলো মিয়ম্রাণ হওয়ার আগ পর্যন্ত চললো ফুলেল শ্রদ্ধা পর্ব।
তখন হয়তো এতটা গভীরে চিন্তার স্রোত ঢেউ খেলেনি। বয়সটা যে ছিল দূরন্তপনার। চঞ্চলতার। উদাসিনতার। এখন একুশের ফেব্রুয়ারি এলে সেদিনের কথা মনে পড়ে। ভাষা শহীদদের জন্য আমাদের পরাণের গহিনে যতনে রাখা কী অকৃত্রিম ভালোবাসা সেদিন দেখেছিলাম! হাতে গড়া শহীদ মিনারের সঙ্গে যে আবেগ জড়িয়ে ছিল, কনক্রিটের শহীদ বেদিতে দাঁড়িয়ে আজও আমি তা ভুলতে পারি না।
বিনম্র শ্রদ্ধা বাহান্নর ভাষা সৈনিকদের প্রতি। যাদের আত্মত্যাগ, অদম্য স্পৃহা আমাদের ভাষার স্বাধীনতা এনে দিয়েছে।
ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন