সচিবালয়ে বিভিন্ন ক্যাডারের সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত প্রায় তিন শতাধিক কর্মকর্তার দীর্ঘদিন নেই কোনো পদোন্নতি। একই ব্যাচের হয়ে কেউ কেউ অতিরিক্ত সচিব এবং এমনকি সচিব হয়েছেন। অনেকে বছরের পর বছর রয়ে গেছে একই পদে। এমন বৈষম্যে চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে প্রশাসনে।জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিসিএস ১০, ১৩, ১৫ ও ১৮তম ব্যাচের সিনিয়র সহকারী সচিবদের উপেক্ষা করে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে বিসিএস ২২তম ব্যাচের বেশিরভাগ কর্মকর্তাদের উপ-সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপ-সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে ৩৯১ কর্মকর্তাকে। ২২তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের উপ-সচিব করতে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) সভায় বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
১৮তম ব্যাচের কয়েকজন সিনিয়র সহকারী সচিবের দাবি, চাকরিজীবনে তাদের নেতিবাচক কিছুই ছিল না। অথচ চারবারেও তাদের পদোন্নতি হয়নি।
তারা বলেন, এতে আমাদের কোনো ক্ষোভ নেই, কিন্তু মনে কষ্ট আছে। আমরা যেহেতু সরকারি চাকরিজীবী তাই আমাদের ক্ষোভ থাকতে নেই। পদোন্নতি দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো দোষ নেই।
জানা গেছে, ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ থেকে চার ধাপে পদোন্নতি দিলেও বর্তমানে ১৮তম ব্যাচে পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন সাতজন। প্রায় সব যোগ্যতা থাকলেও পদোন্নতি না পাওয়ায় বঞ্চিত কর্মকর্তারা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের দুঃখের কথা জানিয়েছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পদোন্নতি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, পদোন্নতি পাওয়া একজন কর্মকর্তার চাকরির অধিকার। তবে পদোন্নতি দেয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কাঠামোর দিকে যেমন লক্ষ্য রাখতে হয়, তেমনি সার্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় নিতে হয়।
যারা সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপ-সচিব হচ্ছেন, তাদের অধিকাংশ ২২তম ব্যাচের। অথচ চারবার পদোন্নতি দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত ১৮তম ব্যাচের কয়েকজন পদোন্নতি থেকে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছেন।
এবিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন উপ-সচিব বলেন, উপ-সচিব পদে পদোন্নতির বিষয়টি একটি নৈতিক দাবি। এর যৌক্তিকতা ও বাস্তবতা বিবেচনা করেই প্রশাসনে পদোন্নতি দেয়া হয়। কেউ পদোন্নতি চাইলেই পদোন্নতি দেয়া হবে তা নয়।
পদোন্নতির নীতিমালা যথাযথ মানা হয়ে থাকলে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মাঝে চাপা ক্ষোভ কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে পদোন্নতির দায়িত্বে থাকা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. শওকত আহমাদ পরিবর্তন ডটকমেকে বলেন, ‘পদোন্নতির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেয়া হয়। এটা স্বাভাবিক। যাদের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড পছন্দসই, তাদের বিষয়ে পজিটিভ সিদ্ধান্ত। এ কারণে ক্ষোভ থাকতেও পারে।’
পদোন্নতি বঞ্চিতদের এমন ক্ষোভের পেছনে রয়েছে নানা যুক্তি। সরকারের উপ-সচিব পদমর্যাদা থেকে সচিব পর্যন্ত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি কিভাবে হবে তা নিয়ে আছে নীতিমালা। সরকার ২০০২ সালে সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের সাথে পরামর্শ করে এ নীতিমালটি প্রণয়ন করে।
নীতিমালার ৪ নম্বর ধারায় পদোন্নতির ভিত্তি হিসেবে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার মেধা, দক্ষতা ও জ্যেষ্ঠতা হবে পদোন্নতির ভিত্তি। কিন্তু বর্তমানে এসব যোগ্যতাকে মাপকাঠি হিসেবে ধরা হচ্ছে না বলে গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেছেন পদোন্নতি না পাওয়া বেশকিছু কর্মকর্তা।
তাদের বলেন, না আমাদের পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে, না আমাদের বলা হচ্ছে কোন কারণে দেয়া হচ্ছে না পদোন্নতি।
এ বিষয়ে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক উপ-সচিব পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, এসব নিয়ে কথা বলা মুশকিল। পদোন্নতি পেতে চাইলে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কনভিন্স করতে হবে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, পছন্দের অফিসারদের পদোন্নতি দিতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর কাছেও ভুল তথ্য দেয়া হচ্ছে। যতদূর জানি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সম্প্রতি একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, জ্যেষ্ঠতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পদোন্নতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমলে নেই সেই চিঠিও।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তার দাবি, প্রশাসন ক্যাডারে বেশি সংখ্যাক অফিসার নিয়োগ পান। একসময় পদোন্নতির জন্য কর্তাব্যক্তি হন তারাই। যারা ফলে তাদের দ্বারা অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। অথচ নিয়ম আছে উপ-সচিব পর্যন্ত পদোন্নতির পর কে কোন ক্যাডার থেকে এসেছে তা আমলে নেয়ার সুযোগ নেই। তখন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার মেধা, দক্ষতা ও জ্যেষ্ঠতাকে গুরুত্ব দিয়ে পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। বিধিমালা থাকা সত্তেও তা পুরোপুরি মানা হচ্ছে না।
এ বিষয়ে পদোন্নতি বঞ্চিত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, দেখুন, আমাদের প্রশাসনে অনেক সচিবও আছেন যাদের অনেকে আমার ব্যাচমেট।
তার আক্ষেপ, সচিবরা এ দেশের উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। যদি রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি দিয়ে সচিব করা হয়, তাহলে মেধাবীদের কাছ থেকে সার্ভিস পাবে না রাষ্ট্রযন্ত্র। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ। একজন ব্যাক্তির রাজনৈতিক যোগ্যতাই বড় যোগ্যতা হতে পারে না।
এই কর্মকর্তা বলেন, একজন উপ-সচিব দুই বছর এ পদে থাকার পর তিনি পদোন্নতির উপযোগী হোন। কিন্তু এ বিধান অসংখ্য অফিসারের ক্ষেত্রে মানা হয়নি। আপনি খুঁজে খুঁজে কথা বলুন, অনেকে আপনার সামনে কেঁদে দেবে।
তিনি বলেন, আমার সাথে ১৯৮৪ সালের ব্যাচ থেকে বেশ কিছু কর্মকর্তা অতিরিক্ত সচিব, এমনকি সচিব হিসেবেও পদোন্নতি পেয়েছেন। কিছু আছেন এক ব্যাচ জুনিয়র হয়েও অনেকে সচিব হয়েছেন।
‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দিন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মাদ মুসলিম চৌধুরী, শিক্ষা সচিব মো. সোহরাব হোসেন, আইসিটি সচিব সুবীর কিশোর চৌধুরী, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকার, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহাবুদ্দিন আহমদ এবং মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. রইসুল আলম মন্ডল ১৯৮৪ সালের ব্যাচের হয়েও তারা পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন সচিব। কিন্তু, আমরা আজও উপ-সচিব’ যোগ করেন এই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, ‘কী কারণে আজও পদোন্নতি হয়নি তাও জানি না। পদোন্নতির দায়িত্বে থাকা কর্তাব্যক্তিরা আমাদের পরিষ্কার করে বলেন না, আমাদের সমস্যাটা কোথায়। যাক, আর দরকার নেই। যে কয়দিন আছি এভাবেই থাকতে চাই। এখন আর উপ-সচিব হিসেবে পরিচয়ও দেই না। কেউ প্রশ্ন করলে বলি- ব্যবসা করি, এতটুকুই।’
পদোন্নতিতে রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারের সাবেক সচিব এসএম জহুরুল ইসলাম পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, এটা আগেও ছিল। তবে এখন অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। পদোন্নতি যে ফেয়ার হচ্ছে এটা বলা যাবে না।
তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে মেধাবী কর্মকর্তারা বিনা কারণে পদ বঞ্চিত হচ্ছেন। এটা এখন ওপেন সিক্রেট। এক্ষেত্রে সবসময় যে রাজনৈতিক নেতাদের দায়ী করা যাবে তা নয়। আমলারাও অতিউৎসাহিত হয়ে এ কাজে সহায়তা করে।
জহুরুল ইসলাম বলেন, আপনারাও জানেন, যারা মেধাবী তারা পড়াশোনা করে ফার্স্ট হতে চায়। আর যারা দুষ্ট প্রকৃতির তারা সবসময় ষরযন্ত্রের আশ্রয় নেয়। তাদের ষড়যন্ত্র করা ছাড়া উপরে ওঠার তো কোনো বিকল্প পথ নেই। তারা দালালি করে, চামচামি করে ও পদচুম্বন করে নিজেদের উপরে ওঠার পথ তৈরি করে নেয়। পরে তারাই এসব যোগ্য অফিসারদের প্রমোশন ঠেকাতে সব ধরনের প্রচেষ্টা চালায়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন