বাংলাদেশে চীনের ‘প্রভাব’ নিয়ে ভারতের সন্দেহ, অবিশ্বাস ও উদ্বেগ দূর করার চেষ্টা করছে সরকার। এর জন্য সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে নয়াদিল্লিকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আশ্বস্ত করে বলা হয়েছে, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। স্ট্র্যাটেজিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের কাছে নিকটতম প্রতিবেশী ও ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারতই অগ্রাধিকার পায়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের কাছ থেকে ডুবোজাহাজ (সাবমেরিন) কেনাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ভারতের উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে দেশটির সংবাদমাধ্যমে। ভারতের গণমাধ্যমের জ্যেষ্ঠ সম্পাদক/সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধিদল চলতি সপ্তাহে ঢাকায় বাংলাদেশ-ভারত গণমাধ্যম সংলাপে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাকায় গণভবনে ওই সাক্ষাতের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বিষয়ে ভারতের সাংবাদিকদের স্পষ্ট করেছেন। ওই সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম।
প্রধানমন্ত্রী ভারতের সাংবাদিকদের বলেছেন, ঢাকা-পেইচিং সম্পর্ক নিয়ে নয়াদিল্লির উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত নয়। ভারত, চীন, জাপান এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে। প্রধানমন্ত্রী যুক্তি দেখিয়েছেন বাংলাদেশের উন্নয়ন করতে হবে।
তাই দেশে বিদেশি বিনিয়োগ ও সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী মনে করেন, ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার বিকল্প নেই। পারস্পরিক সহযোগিতায় এ অঞ্চলের উন্নয়ন হলে জনগণই সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে।
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পরদিন গত বুধবার প্রধানমন্ত্রীর তথ্যবিষয়ক উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরীও সংলাপ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বলেছেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে দুদেশের সম্পর্ককে চমৎকার বলে মন্তব্য করেছেন। সফরকারী ভারতের সাংবাদিকরাও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বর্তমান অবস্থাকে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো বলে অভিহিত করেছেন।
এই সুসম্পর্কের মধ্যেও সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয় যেমন—তিস্তা চুক্তি সইয়ে দেরি, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের অবস্থান এবং আসামে কথিত বাংলাদেশি ইস্যু ঢাকায় অস্বস্তি ও হতাশা সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে এই বিষয়গুলো বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনের আগে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ভারতীয় সাংবাদিকদের সামনে আগামী নির্বাচনের আগেই তিস্তা চুক্তি সইয়ের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর ভারতের চাপ প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান তিস্তাকে ‘দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর তথ্যবিষয়ক উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেছেন, আসামে বাঙালি চিহ্নিত করার ঘটনা যদি শেষ পর্যন্ত বিতাড়নে রূপ নেয় তবে তা বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সংকটের মতো আরেকটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে।
পশ্চিমা বেশ কিছু দেশ বিএনপি জোটের অংশগ্রহণ ছাড়া ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যখন সমালোচনা করেছিল, তখন ওই নির্বাচনকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা হিসেবে অভিহিত করেছিল ভারত। ওই নির্বাচনের পরপর চীন নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি পাঠায়। ক্ষমতাসীন সরকার ভারত ও চীন উভয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখলে সাম্প্রতিক সময়ে ওই দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত প্রতিযোগিতা ঢাকার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।
সম্প্রতি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে ২৫ শতাংশ শেয়ার কেনা নিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। জানা গেছে, চীনা সাংহাই অ্যান্ড শেনঝেন স্টক এক্সচেঞ্জ ভারতের ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ে বেশি দাম প্রস্তাব করেছে। তবে ভারতীয়দের যুক্তি, বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ও অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের কথা চিন্তা করলে চীনা প্রস্তাব খুব একটা টেকসই হবে না। পাকিস্তানের বাজারে চীনা স্টক এক্সচেঞ্জ প্রবেশ করে তেমন একটা সাফল্য দেখাতে পারেনি। ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় সাফল্যের রেকর্ড আছে এমন প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে গুরুত্বপূর্ণ স্থিতিশীলতা আনতে পারে বলে মনে করছে ভারত।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে ভারত মহাসাগরে কর্তৃত্বের লড়াই ও মালদ্বীপ পরিস্থিতি ভারত-চীন কৌশলগত প্রতিযোগিতাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকার ভারতকে বোঝানোর চেষ্টা করছে, বাংলাদেশে তাদের কে বন্ধু আর কে শত্রু তা না বুঝলে কৌশলগত প্রতিযোগিতায় ভারত পিছিয়ে পড়বে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন