আর্থিক জগতের কেলেঙ্কারি প্রকাশ করে একের পর এক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করছে পানামা ও প্যারাডাইস পেপারস। অর্থ পাচারের ঘটনায় এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ৮২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম ফাঁস হয়েছে। সম্পদশালীদের অঢেল টাকার পাহাড় যে বিদেশে রয়েছে তা পুরোপুরি জানতে তদন্তও চলছে। আশা করা যায়, তদন্ত সংস্থাও সময় হলে গোমড় ফাঁস করে দেবে। এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত এখন অনেকটাই তদন্ত সংস্থার হাতে। বিদেশে কে কত টাকা পাচার করেছেন, কীভাবে করেছেন, কোন খাতকে কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছেন ও কার মাধ্যমে করেছেন সব জানার চেষ্টা চলছে। এতে সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থা ভূমিকা রাখছে। কার কত টাকা আছে সে তথ্য জানতে সংস্থাটির পক্ষে কাজ করছেন একটি বিশেষ টিম। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা পেয়ে এ টিম সক্রিয় হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকার আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত ব্যক্তিদের মুখোশ উন্মোচন করতে চায়। এ ক্ষেত্রে তদন্তে নিয়োজিত সংশ্লিষ্টদেরও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
তদন্ত সংস্থার একটি সূত্র জানায়, প্যারাডাইস পেপারসে সম্প্রতি নতুন করে যে ২০ জনের নাম এসেছে তাদের ব্যাপারে আদ্যোপান্ত জানার চেষ্টা চলছে। অল্প সময়ের মধ্যে এদের জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনতে চিঠি পাঠানো হবে। প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আগের তালিকায় প্যারাডাইস পেপারসে আরো যে ১০ জনের নাম ফাঁস হয়েছে তাদেরও একইভাবে চিঠি দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এই তালিকা গত বছরের নভেম্বরে প্রকাশ হয়েছিল। বহুল আলোচিত প্যারাডাইস পেপারসে এবারের দ্বিতীয় তালিকায় নাম আসে বিতর্কিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসেরসহ ২০ জনের। প্রত্যেকে ইউরোপের মাল্টায় অর্থ পাচার করেছেন বলে তালিকায় তথ্য উল্লেখ করা হয়। দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা অবশ্য বলেন, কারো কারো নামের সঙ্গে ঠিকানার মিল নেই। কেউ আবার বিদেশে থাকেন। আবার ঠিকানা মিললেও কারো কারো নামের ক্ষেত্রে গড়মিল পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, দুই দফায় প্যারাডাইস পেপারস ৩০ জনের নাম প্রকাশ করে। এর আগে পানামা পেপারসে নাম আসে ৫২ জনের। এদের মধ্যে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কয়েকজন চিঠি পেয়ে সময় নিয়েছেন। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে পানামা পেপারসে অর্থ পাচারে ৫২ বাংলাদেশি ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়। অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্ট দুর্নীতি দমন কমিশনের এক কর্মকর্তা বলেন, অর্থ পাচারকারীদের বিষয়ে আরো তথ্য উপাত্ত জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট ও এনবিআরের সিআইসির টিমও কাজ করছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, পানামা পেপারস ও অফশোর কোম্পানি মিলিয়ে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ৮২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামের তালিকা প্রকাশ হয়। কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশে টাকা পাচারে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো জড়িত বলে তথ্যে উল্লেখ করা হয়। আগের পানামা পেপারসে দুই কিস্তিতে ৫২ বাংলাদেশির নাম প্রকাশ হয়েছিল। এ তালিকায় ৩৪ ব্যক্তি ও দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে ৪৫টি অ্যাকাউন্টের তথ্য, ২৩ অ্যাকাউন্টধারীর বাড়ির ঠিকানা, চারজনের দুটি করে অ্যাকাউন্ট এবং দুটি যৌথ অ্যাকাউন্টের তথ্য পাওয়া যায়। প্রথমে প্রকাশিত তালিকাটি ‘পানামা পেপারস’ নামে পরিচিতি পায়। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট (আইসিআইজে) এই তালিকা ঘেঁটে বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্র্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করে। আর পরের দুই কিস্তিতে আইসিআইজে প্যরাডাইস পেপারসে আরো ৩০ জনের তালিকা প্রকাশ করে।
প্রকাশিত তালিকা নিয়ে দুদকের তদন্ত অব্যাহত আছে। দুদকের পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে তদন্ত টিমে আছেন উপপরিচালক আখতার হামিদ ভূঁইয়া ও সহকারী পরিচালক মজিবুর রহমান। তারা কয়েক দফা প্রকাশিত পানামা ও প্যারাডাইস পেপারসে নাম আসা অর্থ পাচারকারীদের বিষয়ে অনুসন্ধান অব্যাহত রেখেছেন।
বহুল আলোচিত পানামা পেপারস কেলেঙ্কারির ঘটনায় যাদের নাম আসে তারা হলেন- কাজী জাফরুল্লাহ, নিলুফার জাফর, আজিজ খান, আঞ্জুমান আজিজ খান, আয়েশা আজিজ, জাফর উমেদ খান, ফয়সাল করিম খান, হাসান মাহমুদ রাজা, খন্দকার মইনুল আহসান (শামীম), আহমেদ ইসমাইল হোসেন, আখতার মাহমুদ, এ এম এম খান, আজমল মইন, দিলিপ কুমার মোদি, সৈয়দ সিরাজুল হক, আমিনুল হক, নাজিম আসাদুল হক, তারিক একরামুল হক, সোহেল হাসান, এফএম জুবাইদুল হক, সালমা হক, মাহতাবুদ্দিন চৌধুরী, উম্মেহ চৌধুরী, ইফতেখারুল আলম, এএসএম মহিউদ্দিন আহমেদ, আসমা মোনেম, শরিফ জাহির, মেহবুব চৌধুরী, কফিল এইচ এস মুয়ীদ, জাইন ওমর, আফজালুর রহমান, মোতাজ্জারুল ইসলাম, মল্লিক সুধীর, ইউসুফ রায়হান রেজা, ইসরাক আহমেদ, নভেরা চৌধুরী, বিলকিস ফাতিমা, ফরহাদ গনি মোহাম্মদ, আবুল বাশার, নিজাম এম সেলিম, মোহাম্মদ মোকসেদুল ইসলাম, সরকার জীবন কুমার ও সেলিমুজ্জামান উল্লেখযোগ্য। তালিকায় ব্যক্তি ছাড়াও প্রতিষ্ঠানের নাম আছে।
অপরদিকে প্যারাডাইস পেপারসে প্রথম তালিকায় নাম আসে আবদুল আউয়াল মিন্টু, আউয়াল নাসরিন ফাতেমা, আউয়াল তাবিথ মো. আউয়াল তাফসির মোহাম্মদ, চৌধুরী-ফয়সাল, মিন্টু-আবদুল আউয়াল, মোগল-ফরিদা ওয়াই, উল্লাহ-শহিদ, তাজওয়ার মো. আউয়ালের অভিভাবক হিসেবে আবদুল আউয়াল মিন্টু, আহমাদ-সামির, আউয়াল-তাজওয়ার মোহাম্মদ। এ তালিকায় নাম আসা প্রতিষ্ঠানটি হলো ব্রামার অ্যান্ড পার্টনার্স অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট-বাংলাদেশ লিমিটেড। সম্প্রতি প্রকাশিত দ্বিতীয় তালিকায় নাম এসেছে বিতর্কিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসের, ফজলে এলাহী চৌধুরী, কেএইচ আসাদুল ইসলাম, জুলফিকার আহমেদ, তাজুল ইসলাম, মোহাম্মদ মালেক, শাহনাজ হুদা রাজ্জাক, ইমরান রহমান, মোহাম্মদ এ আউয়াল, এরিক জনসন আনড্রেস উইলসন, ফারহান ইয়াকুবুর রহমান, তাজুল ইসলাম, আমানুল্লাহ চাগলা, মোহাম্মাদ আতিকুজ্জামান, মোহাম্মদ রেজাউল হক, মোহাম্মদ কামাল ভূঁইয়া, তুহিন সুমন, মাহতাবা রহমান, ফারুক পালওয়ান ও মাহমুদ হোসাইন। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, এদের মধ্যে কয়েকজন বিদেশে আছেন। কারো নামের সঙ্গে ঠিকানার খোঁজ পাওয়া যায়নি।
কর ফাঁকি ও অর্থ পাচারের সঙ্গে বাংলাদেশি নাগরিকদের সম্পৃক্ততায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ঘটনাটিকে ‘প্রকট দুর্নীতি-সহায়ক পরিস্থিতির দৃষ্টান্ত’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সংস্থাটির পক্ষে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণেরও আহ্বান জানানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পানামা ও প্যারাডাইস পেপারসে যাদের নাম এসেছে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া উচিত। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে তদন্ত সংস্থা দুদক আরো কঠোর হবে বলে আশা করছি।
দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, অনুসন্ধানে দুকের চৌকস টিম কাজ করছে। আগে পানামা পেপারসের তদন্তকালে চারজনের কাছে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। জিজ্ঞাসাবাদে পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে নাম আসা ওই চারজনের মধ্যে দু’জনের দাবি হলো, তারা বিদেশে উপার্জন করা অর্থ বিদেশে বিনিয়োগ করেছেন। আরেকজন বলেছেন ইউরোপের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা অর্থ ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে অফশোর কোম্পানিতে লগ্নি করেছেন।
অপরজন বলেছেন, তার উপার্জিত অর্থের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক নেই। ফাঁস হওয়া নথির তথ্য অনুযায়ী, তালিকায় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ঠিকাদারও আছেন। তিনি জানান, প্যারাডাইস পেপারসে যাদের নাম এসেছে তাদেরকেও জিজ্ঞাসাবাদের প্রক্রিয়ার আওতায় আনা হবে। এ ছাড়া কার কত টাকা বিদেশে আছে সেই তালিকা তৈরির কাজও চলছে। কাজটি সময় সাপেক্ষ এবং কঠিন হলেও অনুসন্ধান এবং তদন্তে পরিপূর্ণতার জন্য তা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট এবং এনবিআরের সিআইসির টিম অনুসন্ধানে সহায়তা করছে।
মানবকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন