বাংলাদেশে মায়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসার ছয় মাস পার হচ্ছে। ছয় মাস আগে যখন বাংলাদেশে তারা আশ্রয় নিয়েছিল, তখন কক্সবাজারের মানুষ তাদের আশ্রয় দিয়েছিল, নানা ভাবে সাহায্য করেছিল।
কিন্তু এখনো পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের আসা কমবেশি অব্যাহত রয়েছে, একই সাথে কবে তাদের ফেরত নেয়া হবে সেটা নিশ্চিত নয়। খবর-বিবিসি
কক্সবাজারে এখানকার এক বাজারে একটি চায়ের দোকানে দেখলাম - ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে জোর আলোচনা চলছে, বিষয় মায়ানমার থেকে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী।
বাংলাদেশে সর্বদক্ষিণের এই জেলা কক্সবাজার গত কয়েক মাস ধরে বিশ্ববাসীর নজরে রয়েছে রোহিঙ্গাদের কারণে।
বিশেষ করে কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া উপজেলায় লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়ার কারণে স্থানীয় মানুষের জীবনে যে একটা সার্বিক পরিবর্তন এসেছে, সেটা এখানকার মানুষের সাথে কথা বললেই বোঝা যায়।
মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন একজন কৃষক। ছয় মাসে তার জীবনে কী প্রভাব পড়েছে - তা তিনি বেশ অসন্তোষ নিয়েই ব্যাখ্যা করছিলেন।
তিনি বলেন, ‘তাদের থাকার জায়গা করতে যেয়ে চাষের কোন জমি নেই এখন। গাছ-পালা কেটে একাকার করে ফেলেছে। আমাদের এখন কোন কাজ নেই’।
মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, দিনমজুরের কাজ এখন আর স্থানীয়রা পাচ্ছে না। কারণ রোহিঙ্গারা এসে অল্প টাকায় সব কাজ করছে।
২০১৭ সালের আগস্টের শেষ সপ্তাহে যখন রোহিঙ্গারা দলে দলে মায়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তের নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছিলো, তখন কারো ধারণা ছিল না কি সংখ্যায় তারা আসবে এবং কত দিনের জন্য তারা বাংলাদেশে থাকবে।
গত ছয় মাসে মানুষের মধ্যে একটা মানবিকতা বোধের কারণেই অনেকেই রোহিঙ্গাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়েছে, তাদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু ছয় মাস পরে পরিস্থিতি এবারে ভিন্ন।
স্থানীয় একজন বাসিন্দা রবিউল ইসলাম বলেন, ‘বিশাল জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটাতে যেয়ে আমাদের স্থানীয়দের উপর বিরাট চাপ পড়ছে’।
তিনি বলেন, ‘ধরেন এখানে ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা আছে ৬০ হাজার এনজিও কর্মী। রাস্তায় বের হলে কোন যানবাহন পাওয়া যায় না, আগে যেখানকার ভাড়া ছিল ২০ টাকা - এখন সেখানে ৪০ টাকা ভাড়া’।
রবিউল ইসলামের কাছে এই প্রতিবেদক জানতে চেয়েছিল - যখন তারা এসেছিল তখন বলেছিলেন মানবিকতার কারণে তাদের আশ্রয় দিচ্ছেন. তাহলে এখন এমন কথা কেন?
উত্তরে তিনি বলেন, ‘কয়েক মাসের জন্য আশ্রয় দেয়া যায় কিন্তু মাসের পর মাস তো সম্ভব না। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বার বার বিলম্বিত হচ্ছে এটাও ঠিক না। আমরা চাই তাদের মায়ানমারে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দ্রুত যাতে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়’।
কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ, বালুখালি, কুতুপালং এর নানা পেশা, শ্রেণীর মানুষের সাথে আমি কথা বলেছি।
তাদের সাথে কথা বলে ধারণা পাওয়া গেছে, এসব মানুষ প্রথম পর্যায়ে মানবিকতার কারণে তাদের সাহায্য করলেও এখন সরকারি হিসেবে সাত লক্ষের মত রোহিঙ্গা এবং কয়েক হাজার উন্নয়ন কর্মীর চাপে এই এলাকাতে তাদের দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিকতা হারিয়ে গেছে।
মুদি দোকানদার মো. রফিক বলেন সব জিনিসের দাম বেড়েছে।
তিনি বলেন, আগে ময়দার দাম ছিল ২৫ টাকা এখন সেটা ৩৫ টাকা হয়েছে। ৩০ টাকা দিয়ে লাকড়ি (জ্বালানী কাঠ) কিনতাম এখন সেটা দুইশ টাকা হয়েছে। চালের দাম ৪৫ টাকা। শাক-সবজির দাম অনেক। চারিদিক দিয়ে সমস্যায় আছি আমরা’।
কথা বলছিলাম এখানকার একজন সাথে। তিনি নতুন এক তথ্য দিলেন।
ঘুনধুম হাই স্কুলের শিক্ষক আব্দুল গফুর বলেন, স্কুলের নবম এবং দশম শ্রেণীর অনেক শিক্ষার্থী এখন পার্ট টাইম কাজ করছে বিভিন্ন এনজিও’র সাথে। ফলে তাদের পড়াশোনার ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করছিলেন।
তিনি বলেন, ‘এখন যা চলছে তাতে করে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়বে। মেধাশূন্য হয়ে পড়বে সব এক সময়’।
বাংলাদেশের রোহিঙ্গাদের প্রবেশ আগের মত প্রতিদিন শত শত না হলেও একেবারেই বন্ধ হয়ে যায় নি। এরই মধ্যে চলছে মায়ানমারে তাদের ফেরত পাঠানোর আলোচনা।
কিন্তু কক্সবাজারের মানুষের মনে আগের সেই সহমর্মিতা ছাপিয়ে এখন ঝরে পড়ছে চাপা অসন্তোষ, কখনো সেটা প্রকাশ পাচ্ছে প্রকট ভাবেই।
তারা এখন চাচ্ছেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে যেন তাদের মায়ানমারে ফেরত পাঠানো হয় যে প্রক্রিয়া একই সাথে তাদের আগের সেই স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা দেবে বলে তাদের বিশ্বাস।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন