চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার কারণে তৈরি হওয়া বৈষম্যে সমাজে ক্ষোভের পাশাপাশি শাসন ব্যবস্থায় সৃষ্টি হয়েছে অচলায়তন। এই অচলায়তন ভাঙতেই হবে বলে মনে করেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার
কোটার কারণে স্বাধীনতার পর থেকেই জনপ্রশাসনে নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে মন্তব্য করে চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেছেন, অধিক মেধাবীদের উপেক্ষা করে প্রাধিকার কোটায় কম মেধাবীদের নিয়োগের সুযোগ জনপ্রশাসনের দক্ষতা হ্রাসে ভূমিকা রাখছে। চাকরির সুযোগ লাভে সমতার সাংবিধানিক অঙ্গীকার হলেও তার বিপরীতে যুগ যুগ ধরে কোটা ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
সংবিধানে চাকরিতে নিয়োগ লাভে সবার সমান সুযোগের কথা উল্লেখ করে আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘সংবিধান বলছে, প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে সবার নিয়োগ লাভের সমান অধিকার থাকবে। পাশাপাশি বাস্তবতা বিবেচনায় সংবিধানপ্রণেতারা সমাজের অনগ্রসর শ্রেণির জন্য কোটা সংরক্ষণের বিধানও রেখেছেন। অথচ এখন উচ্চতর সিভিল সার্ভিসের মেধার মাধ্যমে নিয়োগ পান ৪৫ শতাংশ প্রার্থী।
‘এভাবে নিয়োগ হচ্ছে জনপ্রশাসনের বিভিন্ন ক্যাডারে। এর মধ্যে আছে প্রশাসন, কূটনীতিক, পুলিশ থেকে সরকারি কলেজের শিক্ষক আর চিকিৎসক। একইভাবে নিয়োগ হয় নিম্ন আদালতের বিচারক পদেও।’
সামরিক বাহিনীর কমিশন্ড অফিসার পদে কোনো ধরনের কোটা না থাকার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, সেখানে মেধাই নিয়োগের মাপকাঠি।
সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার
বিদ্যামান কোটা ব্যবস্থায়, সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদগুলোতে জনবল নিয়োগে কোটা থেকে নিয়োগ পাচ্ছেন ৫৫ শতাংশ প্রার্থী। বাকী ৪৫ শতাংশের নিয়োগ মেধার ভিত্তিতে।
ওই ৫৫ শতাংশ কোটার মধ্যে রয়েছে; ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতী-নাতনী, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা এবং ৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী ও অন্যান্য কোটা।
তবে কোটাধারী কেউ মেধা তালিকায় ঢুকে পড়লে তার নিয়োগ মেধা কোটাতেই হয়ে থাকে। সেইক্ষেত্রে তার জন্য নির্ধারিত কোটায় নিয়োগ দেওয়া হয় একই কোটায় থাকা অন্যপ্রার্থীকে। আর যোগ্যপ্রার্থী পাওয়া না গেলে, তখন সে পদে কাউকে নিয়োগ না দিয়ে তা সংরক্ষণ করা হয়।
এই কোটা ব্যবস্থার সংস্কার চেয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবাদ আন্দোলন করে আসছেন সাধারণ চাকরীপ্রার্থীরা। শুধু তাই-ই নয় এই ব্যবস্থাকে ‘অযৌক্তিক ও সংবিধান পরিপন্থী’ বলে মত দিয়ে লেখালেখি করছেন সাবেক শীর্ষ আমলা এবং বুদ্ধিজীবীরাও। বিষয়টি নিয়ে সরকারিভাবে অনেক কমিটি-কমিশনও হয়েছে। গবেষণা হয়েছে বেসরকারি পর্যায়ে।
কোটাবিরোধী আন্দোলন
সর্বশেষ সরকারি কর্মকমিশন-পিএসসি ২০০৮ সালে ইউএনডিপির আর্থিক সহায়তায় এ বিষয়ে অভিজ্ঞ দু’জন ব্যক্তিকে দিয়ে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে। সেই সমীক্ষায় তারা গোটা ব্যবস্থাটিকে অন্যায্য এবং জনপ্রশাসনের জন্য ক্ষতিকর বলে মত প্রকাশ করে। তাদের দেওয়া সুপারিশে কোটায় পদ্ধতিতে বড় ধরনের হ্রাসের কথা বলা হয়।
সম্পর্কিত
বাংলাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে: প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশ সীমান্তে বেড়া দিতে মিয়ানমারের ১২৫ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ
নেতাকর্মী আটক ও আহতের ঘটনায় বিএনপির প্রতিবাদ কর্মসূচি সোমবার
একই বিষয় নিয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স স্টাডিজ-আইজিএস‘র করা একটি গবেষণামূলক নিবন্ধেও একই রকম সুপারিশ করা হয়।
চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা তুলে দেওয়া উচিত বলে একাধিক সভা-সেমিনারে মত দিয়েছেন আরেক সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগ আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি বলেন: কোটা ব্যবস্থা তুলে দেওয়া উচিত। কোনো দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য কোটা ব্যবস্থা চলতে পারে না।
সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব ড. আকবর আলী খান
নিজের অবস্থানের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের ক্যাডার নিয়োগে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে কোটা ব্যবস্থা। এর কারণে মেধাবীরা চাকরি পাচ্ছে না। কোটাকে অনেকে খারাপ, ভালো নয়, বাদ দেয়া উচিত এরকম বললেও এর বেশি কিছু বলেন না। পিএসসিতে ২৫৭ ধরনের কোটা রয়েছে। পৃথিবীর কোনো দেশেই এমন উদ্ভট ব্যবস্থা নেই।
কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে চাকরিপ্রার্থীরা বড় ধরনের আন্দোলনে নামে ২০১৩ সালের জুলাইয়ে। কিন্তু সে আন্দোলনে ফল আসেনি। এরপর কখনও মৃদু, কখনও বা জোরালো আওয়াজ ওঠে এ দাবির পক্ষে।
সম্প্রতি আবার জোরালো হচ্ছে কোটা সংস্কারের দাবি। চলতি বছরেই একাধিকবার মানববন্ধন সমাবেশ হয়েছে রাজধানীসহ সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায়।
আগামীকাল রোববার বড় ধরনের কর্মসূচি ডাকা হয়েছে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’র ব্যানার থেকে। এ জন্য শনিবার রাজধানীর শাহবাগ পাবলিক লাইব্রেরি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেন্ট্রাল লাইব্রেরি থেকে চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে ১০ টাকা করে চাঁদাও তোলা হয়েছে।
এর পক্ষে জনমত তৈরি করতে ‘কোটা সংস্কার চাই’ ফ্রেম দিয়ে ফেসবুকের প্রোফাইল ছবি ব্যবহার করছেন অনেকেই।
কোটাবিরোধী আন্দোলন
বিগত কয়েকটি বিসিএসের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া যাওয়ায় ২৮তম থেকে ৩৫তম বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডারে সাড়ে তিন হাজার পদ খালি থেকে গেছে। এর মধ্যে ২৮তম বিসিএসে ৮১৩টি, ২৯তম বিসিএসে ৭৯২টি, ৩০তম বিসিএসে ৭৮৪টি, ৩১তম বিসিএসে ৭৭৩টি এবং ৩৫তম বিসিএসে ৩৩৮টি পদ শূন্য থেকে যায়।
২০ শতাংশের বেশি কোটা থাকা উচিত নয় উল্লেখ করে আলী ইমাম মজুমদার বলেন, আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোনো কোটাই একেবারে বিলুপ্ত করা হয়তো সম্ভব হবে না। তবে সরকারের অঙ্গীকার অনুসারে মেধা কোটা যৌক্তিক পরিমাণে বৃদ্ধির ব্যবস্থা নেওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে পরিমাণটা কত হবে, তা নিয়ে বিতর্ক হবে। যদি বলা হয় সেটা শতকরা ৮০ হতে হবে, তাহলে আদৌ অন্যায্য হবে না। সব কোটাই ২০ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ করতে হবে। এটা সম্ভব ও সমীচীন।
প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নিজের ভাগ বুঝে নিতে হলে মেধার দাপট প্রয়োজন। আর তা করতে হলে প্রতিটি চাকরিতে সর্বোচ্চ মেধাবীদের স্থান দেওয়ার দাবিই যৌক্তিক বলেও মত দেন সাবেক এ আমলা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন