নেপালে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত বাংলাদেশি নাগরিকদের মরদেহ দ্রুত দেশে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। মঙ্গলবার সকালে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা হাসপাতালের ফরেনসিকে নিহত বাংলাদেশি নাগরিকদের স্বজনরা পৌছান। এসময় স্বজনদের বুক ফাটা আহাজারিতে এক হৃদয় বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
সোমবারের ওই দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত অন্তত ২৬ বাংলাদেশি মারাগেছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এই সব মরদেহ কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা হাসপাতালের ফরেনসিক ল্যাবে রয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। খবর-বিবিসি অবলম্বনে
কাঠমান্ডু থেকে আবুল কালাম আযাদ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের ডাক্তার প্রমোদ শ্রেষ্ঠকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছেন, পরিচয় সুনিশ্চিত হয়েই তারা মৃতদেহ হস্তান্তর করতে চান। মরদেহ পরিচয় জানতে চারটি দল কাজ করছে। এর মধ্যে দুটি দল ময়না তদন্ত করছে। একটি দল মরদেহের নানা স্যাম্পল নিয়ে সেখান থেকে পরিচয় জানার চেষ্টা করছে আর অন্যটি পরিবারের স্বজনদের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য নিয়ে নিশ্চিত হবার চেষ্টা করছে।
এই চারটি দল সম্মিলিতভাবে একটি মরদেহের পরিচয় নিশ্চিত করার কাজটি সম্পন্ন করবে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই প্রতিটি মরদেহের ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহ করা হচ্ছে বলেও জানানো হচ্ছে।
মঙ্গলবার ১১ টি মরদেহের পোস্ট মর্টেম সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু এই এগার জন কারা সেটি নিশ্চিত করা যায়নি। ৪৯টি লাশের ময়না তদন্ত চলবে আরো কয়েকদিন। কর্তৃপক্ষ বলছেন পরিচয় নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে স্বজনের কাছে হস্তান্তর কিংবা নিজ দেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব নয়।
ডাক্তার প্রমোদ শ্রেষ্ঠ আরো জানান, এ প্রক্রিয়ার পরেও যদি পরিচয় নিশ্চিত না হয় তাহলে শেষ কাজটি হবে ডিএনএ পরীক্ষা করা।
‘কাঠমান্ডু খুব সহজ এয়ারপোর্ট না’
‘কাঠমান্ডু কিন্তু খুব একটা সহজ এয়ারপোর্ট না। সেখানে সবচেয়ে ভালো পাইলটদের পাঠাতে হয়। তাই করে সব এয়ারলাইনস। হঠাৎ করে দুইটা পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে এয়ারক্রাফটা ঢুকে যেতে হয়।’
নেপালের কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রসঙ্গে এসব কথাই বলেন বৈমানিক ও বিমানচলাচল বিষয়ক (অ্যাভিয়েশন) বিশেষজ্ঞরা।
সোমবার ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের সময় বিধ্বস্ত হয় ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একটি বিমান। বিমানে যাত্রী ছিলেন ৬৭ জন। চারজন ছিলেন ক্রু। ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৫১ জন মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ওইদিনই দুপুরে ঢাকা থেকে রওনা দেয় বিমানটি।
কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের সাথে বিধ্বস্ত বিমানের পাইলটের কথোপকথনের কিছু অংশ প্রকাশ পায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেই অডিও বার্তাতেই স্পষ্ট হয়ে উঠে নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার এবং পাইলটের ভুল-বোঝাবুঝির বিষয়টি। বিশ্লেষকরা বলছেন, টাওয়ার থেকে বেশ কয়েকবার বিভ্রান্তিমূলক বার্তা ও অবান্তর কথা বলা হয়েছে, যা এভিয়েশন নীতিবহির্ভূত।
বিমান এয়ারলাইনস পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ক্যাপ্টেন এস এম নাসিমুল হক বলেন, ‘ক্লিয়ার টু ল্যান্ড বলার পরে স্পেসিফাইও (নির্দিষ্ট) করেননি (টাওয়ার থেকে) কোন রানওয়ে। কিন্তু বলছেন, তুমি কি রানওয়ে দেখেছ? তারপর আবার ক্লিয়ারেন্স দেওয়ার পরও (পাইলট) যখন ল্যান্ড করতে আসছে তখন হঠাৎ করে বলছে যে টার্ন রাইট। কেন টার্ন রাইট? এ কনফিউশনগুলো সাধারণত টাওয়ারগুলো করে না।’
আরেক অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ নাফিজ ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘বলা হয়েছে আরেকটা এয়ারক্রাফট বোধহয় টেক অফ (উড্ডয়ন) করছে, ফাইনাল স্টেজে আছে। তারপর আবার তার সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে তখন তাকে বলছে যে তুমি কোন এন্ড (প্রান্ত) থেকে আসতে চাও। তারপর আবার বলা হচ্ছে তুমি হোল্ডিং প্যাটার্নে যাও। এ কনফিউশনগুলো (বিভ্রান্তি) আমরা দেখতে পাচ্ছি।’
সাধারণত বিমান অবতরণের সময় নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের সঙ্গে মূল যোগাযোগ স্থাপন করে থাকে ফ্লাইটের কো-পাইলট। কিন্তু বিধ্বস্ত বিমানের পাইলট আবিদ নিজেই একইসঙ্গে ফ্লাইট পরিচালনার পাশাপাশি টাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন।
নাসিমুল হক বলেন, ‘ক্যাপ্টেন ফ্লাইও করছিল আবার আরটিতে কথাও বলছিল। প্রশ্ন আসে কেন তিনি কথা বলছিলেন। তাহলে কি উনার কনফিডেন্স ছিল না ফার্স্ট অফিসারের ওপর? তাহলে কি ফার্স্ট অফিসার পারছিল না তাঁর কাজ করতে? তাই যদি হয় তাহলে ট্রেনিং পর্যাপ্ত হয়নি বা কোম্পানি অ্যাসেস (পরীক্ষা) ঠিকমতো করতে পারেনি: বাচ্চাটা কাঠমান্ডু যাওয়ার লায়েক (উপযুক্ত) কি না।’
নাফিজ ইমতিয়াজ বলেন, ‘এটিসির (এয়ার ট্রাফিক কনট্রোল) সঙ্গে কথাবার্তা সাধারণত কো-পাইলট শুরু করেন। কিন্তু পাইলট ক্যান স্পিক ফ্রিলি। কারণ ডিসিশনটা আলটিমেটলি পাইলটের।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক বিমানবন্দরগুলোর একটি কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দর। তাই পাইলটদের অতিরিক্ত সতর্কতার সঙ্গে বিমান উঠানামার বিষয়টি পরিচালনা করতে হয়। থাকতে হয় বিশেষ প্রশিক্ষণও। ত্রিভুবন বিমানবন্দরে অবতরণের সময় প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় বিশাল পাহাড়, আর পাহাড় পেরোনোর পর পরই দ্রুত অবতরণ করাতে হয় উড়োজাহাজকে।
নাসিমুল হক বলেন, ‘কাঠমান্ডু কিন্তু খুব একটা সহজ এয়ারপোর্ট না। কাজেই সেখানে একটু বিজ্ঞ লোক নেওয়া ভালো। কাঠমান্ডুতে একটু সিরিয়াসলি চিন্তা করে যাওয়া ভালো।’
নাফিজ ইমতিয়াজ বলেন, ‘কাঠমান্ডুতে সবচেয়ে ভালো পাইলটদেরকে পাঠাতে হয়। তাই করে সব এয়ারলাইনস। হঠাৎ করে দুইটা পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে এয়ারক্রাফটা ঢুকে যেতে হয়।’
নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটির নিরাপত্তা নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হয়। ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৭০টির বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৬৫০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন