কদরুদ্দিন শিশির
বাংলাদেশের অনলাইন জগতে আজ মঙ্গলবার (১৩ মার্চ) একটি খবর ভাইরাল হয়েছে। সামাজিক মাধ্যম তো বটে, মূলধারার বেশ কয়েকটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমে সংবাদ প্রতিবেদন পরিবেশিত হয়েছে।
দৈনিক যুগান্তরের অনলাইনে প্রকাশিত “পাইলট প্রিথুলার দৃষ্টান্ত: ১০ নেপালিকে বাঁচাতে জীবন দিলেন” শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে ঘটনা সম্পর্কে ধারণা নেয়া যাক।
লেখা হয়েছে--
“নেপালের কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বিমানটির বাংলাদেশি কো-পাইলট প্রিথুলা রশিদ। নিজের জীবনের বিনিময়ে বিমানটির ১০ নেপালি যাত্রীকে বাঁচিয়েছেন তিনি। ইউএস-বাংলার প্রথম নারী পাইলট প্রিথুলা নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী।”
তথ্যের সূত্র হিসেবে যুগান্তর লিখেছে, “দুর্ঘটনার পর সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে ‘সিকিম ম্যাসেঞ্জার’ নামে একটি পেজে প্রিথুলার মহানুভবতার কথা তুলে ধরে বলা হয়, ‘আজ নেপালি নাগরিকদের বাঁচাতে গিয়ে বাংলাদেশি কন্যা তার নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। অন্যের জীবন বাঁচাতে গিয়ে কাঠমান্ডুতে আজ এই বাংলাদেশি তরুণী পাইলট মারা গেছেন।”
কালের কণ্ঠের অনলাইনে বলা হয়েছে--
“ইউএস বাংলার সহকারী পাইলট প্রিথুলা রশিদ মারা গেছেন। কিন্তু নিজের জীবনের বিনিময়ে বীর ওই নারী পাইলট বাঁচিয়ে গেছেন ১০ নেপালি যাত্রীর প্রাণ। নেপাল ও ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সোশ্যাল সাইটে ‘ডটার অব বাংলাদেশ’ আখ্যা দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে।”
লক্ষ্যণীয় হল, পত্রিকাটি ‘সোশ্যাল সাইট’ এর পাশাপাশি ‘নেপাল ও ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যম’কে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করেছে। কিন্তু কোন কোন গণমাধ্যম তার একটিরও নাম দেয়নি।
এভাবে পৃথুলার ‘আত্মত্যাগ’ ও ‘বীরত্ব’ নিয়ে অত্যন্ত আবেগঘন বর্ণনায় বহু প্রতিবেদন নানা অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত হয়েছে; এবং এসব প্রতিবেদনের কোনো কোনোটি সামাজিক মাধ্যমে ২০ হাজারবারেও বেশি শেয়ার হয়েছে। নিচে কয়েকটি শিরোনাম উল্লেখ করছি শুধু।
ঢাকাটাইমস- নেপালি যাত্রীদের জন্য উৎসর্গ পৃথুলার জীবন
সারাবাংলা- ‘ডটার অব বাংলাদেশ সেকরিফাইজড হার লাইফ’
চ্যানেল আই অনলাইন- মৃত্যুর আগে ১০ নেপালি যাত্রীকে বাঁচিয়েছিলেন বীর নারী পাইলট
সময়টিভি অনলাইন- 'ডটার অব বাংলাদেশ' প্রিথুলা রশিদ
একুশে টিভি অনলাইন- দশ নেপালিকে বাঁচাতে জীবন দিল প্রিথুলা
বাংলাদেশ প্রতিদিন- ১০ নেপালিকে বাঁচাতে জীবন উৎসর্গ করেছেন প্রিথুলা
সবার সূত্র Sikkim Messenger:
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে ‘ভারত ও নেপালের’ নামহীন গণমাধ্যমের পাশাপাশি নাম উল্লেখ করে যে ফেসবুক পেইজের বরাতে সংবাদটি প্রকাশ করা হয়েছে সেটির নাম ‘Sikkim Messenger’। পেইজটির ঠিকানা হিসেবে ভূটানের সিকিমের নাম দেয়া আছে। একইসাথে www.sikkimmessenger.com নামে একটি ওয়েবসাইটের নাম পেইজটিতে পাওয়া গেলেও কয়েকবার চেষ্টা করে সাইটটিতে ঢুকা যায়নি।
‘Sikkim Messenger’- এ পৃথুলা সম্পর্কে লেখা হয়েছে--
“Daughter of Bangladesh sacrificed her life while saving the citizens of Nepal today:
This young Pilot from Bangladesh dies in a tragic plane crash today in Kathmandu while saving Nepali citizens.
Her name was Miss Pritula Rashid. She was a Co-Pilot of #USBangla Airlines (Flight BS211) which crashed today in Tribhuwan Airport of Kathmandu in Nepal today. However, she tried her best to save around 10 Nepali nationals before she died, who are alive now.”
কিন্তু পেইজটিতে এই তথ্যের কোনো সূত্র উল্লেখ করা হয়নি। যেহেতু ‘Sikkim Messenger’ কোনো চেনা-জানা সংবাদমাধ্যম নয়, এবং কোনো সংবাদমাধ্যম বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষীয় সূত্রের উল্লেখ নেই তাদের পোস্টে, ফলে এটির বিশ্বাসযোগ্যতা একদম প্রাথমিক পর্যায়েই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়।
ভারত ও নেপালের নামহীন গণমাধ্যম’ এর সূত্র:
যুগান্তরের রিপোর্টে ‘Sikkim Messenger’ এর পাশাপাশি ভারত ও নেপালের গণমাধ্যমে খবরটি প্রকাশিত হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। কালের কণ্ঠ ও চ্যানেল আই অনলাইন, সারাবাংলা ডটনেট ইত্যাদির রিপোর্টে শুধু নেপালের গণমাধ্যমের কথা বলা হয়েছে। আবার সময়টিভি এর অনলাইনে শুধু ‘Sikkim Messenger’ এর বরাত দেয়া হয়েছে।
যেসব সংবাদমাধ্যমে নেপাল ও ভারতের সংবাদমাধ্যমের কথা বলা হয়েছে সেগুলোতে কোনো সংবাদমাধ্যমের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
bdfactcheck.com এর পক্ষ থেকে তাই নেপালের মূলধারার কয়েকটি ইংরেজি সংবাদমাধ্যম এবং ভারতের কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন খোঁজ হয়েছে। এছাড়া গুগলে Daughter of Bangladesh, Prithula Rashid, US Bangla Plane Crash, Saves 10 Passengers, Nepal, Nepalese ইত্যাদি বিভিন্ন কীওয়ার্ডকে নানাভাবে মিক্স করে সার্চ করেও কোনো এ সংক্রান্ত কিছু পাওয়া যায়নি।
শুধু ইংরেজিতে দু’টি সার্চ রেজাল্ট এসেছে। এর একটি হচ্ছে কালের কণ্ঠ অনলাইনের ইংরেজি ভার্সনের একটি রিপোর্ট আর steemit.com নামে একটি ব্লগের (সংবাদমাধ্যম নয়) ‘Hero girl pilot who saved 10 Nepalese passengers before death’ শিরোনামের একটি রিপোর্ট। এই দুটিতেও মূল সূত্র হিসেবে ‘নেপালি সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যম’ এর কথা বলা হয়েছে।
নেপালের একজন সাংবাদিক যা বললেন:
নেপালের সংবাদমাধ্যমে পৃথুলাকে নিয়ে এ ধরনের কোনো খবর প্রকাশিত হয়েছে কিনা এ বিষয়ে আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য bdfactcheck.com এর পক্ষ থেকে নেপালে Kathmandu Post এ কর্মরত সাংবাদিক Sangam Prasain এর সাথে যোগাযোগ করা হয়। তিনি জানান, মৃত্যুর আগে পৃথুলা ১০ জন নেপালি যাত্রীকে বাঁচিয়েছিলেন- এ ধরনের কোনো খবর সে দেশের কোনো সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি।
এই সাংবাদিক আরও বলেন, “এটা সম্ভব নয়। (বিমানে থাকা) ৩৩ জন যাত্রীর মধ্যে মাত্র ১১ জন বেঁচে আছেন। আমি যতটুকু জানি তাকে (পৃথুলা) ককপিট থেকে অজ্ঞান অবস্থায় বের করা হয়েছে। ককপিট বিস্ফোরিত হয়েছিল। ফলে (বিধ্বস্ত) ককপিট থেকে তিনি বের হয়ে গিয়ে অন্যদের জীবন বাঁচিয়েছেন- এমনটি হওয়ার কোনো সুযোগই নেই।”
Sangam Prasain এর সাথে ফেসবুকে আলাপের স্ক্রিনশট তুলে দেয়া হল--
সামাজিক মাধ্যমে সংবাদটি ব্যাপকভাবে শেয়ার হচ্ছে দেখে একটি বিদেশি নামকরা সংবাদমাধ্যমের বাংলাদেশ প্রতিনিধি একজন ফেসবুক ব্যবহারকারীর পোস্টে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মন্তব্য করেন, তিনি নেপালের সংবাদমাধ্যমে এ ধরনের কোনো খবর দেখেননি।
স্ক্রিনশট--
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে খবরটির যে দু’টি সুত্রের কথা বলা হয়েছে তার একটি হচ্ছে অখ্যাত এক ফেসবুক পেইজের সূত্রহীন পোস্ট। আর দ্বিতীয়ত, ‘ভারতও নেপালের গণমাধ্যম’ এর যে রেফারেন্স দেয়া হয়েছে সেটিও সঠিক নয় বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। ফলে খবরটির বিশ্বাসযোগ্য ‘শূন্য’ বলাই যায়।
নোট:
প্রিয় পাঠক, আমাদের এই ফ্যাক্টচেকের উদ্দেশ্য পৃথুলা রশিদকে খাটো করে দেখানো নয়। পৃথুলার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা অপরিসীম, আমাদের দোয়া তার জন্য আর তার স্বজনদের জন্য। আমাদের শ্রদ্ধা ও দোয়া দুর্ঘটনায় নিহত বাকি ৪৮ জনের জন্যও। মৃত্যুর মুহূর্তে তিনি কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন, কিম্বা করেননি- মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা পাওয়ার পথে এটি কোনো বাধা নয়।
bdfactcheck.com কাজ করছে ভূয়া তথ্য ও গুজবের বিরুদ্ধে। আমরা বিভ্রান্তিহীন একটি সমাজ চাই। ফলে ভূল তথ্য বা গুজবকে ‘সত্য’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে বাধা দিতে আমরা পিছপা হইনা।
এই কাজটি করতে গিয়ে অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করেছি, পৃথুলাকে নিয়ে খুবই বাজে ধরনের নারীবিদ্বেষী মন্তব্য করা হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। আমরা এর নিন্দা জানাই। একই সাথে সূত্রহীন ‘উড়ো সংবাদ’কে অবলম্বন করে সংবাদমাধ্যমে যে ‘অতি-জাতীয়তাবাদী আবেগের’ চর্চাও হচ্ছে, এটিও সমর্থনযোগ্য নয়।
bdfactcheck
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন