দশ বছরের আয় দিয়ে তিলে তিলে নিজের সংসার গড়ে তুলেছিলেন ড্রাইভার মিলন শেখ। গত সোমবার মিরপুর ১২ নাম্বারের ইলিয়াস আলী মোল্লা বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডে তার তিনটি ঘরই পুড়ে গেছে। ঘটনার দুটদিন পর বুধবার বিকেলে বস্তিটিতে গিয়ে দেখা যায়, নিজের ঘরের আধপোড়া টিন ও আর স্টীলের আসবাবগুলো সরিয়ে আলাদা করে রাখছেন মিলন।
এগুলো দিয়ে কী করবেন জানতে চাইলে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি বলেন, ‘এই শহরে তো থাকনের মতো আমার আর কোনো জায়গা নাই। দেহি এই আধপোড়া টিনগুলারে একটু ঠিকঠাক কইরা আপাতত মাথার উপরে চাল উঠাইয়া থাকতে পারি কিনা।’
কথাগুলো বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠেন মিলন। এরপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘দশ বছরের ইনকামের টেকা দিয়া একটু একটু কইরা অনেক কিছুই করছিলাম। আগুনে সব শেষ কইরা দিল। বউ-পোলাপান লইয়া এক কাপড়ে ঘর ছাইড়া বাইর হই। একটা সুতাও নিয়া বাইর হইতে পারি নাই।’
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, পুড়ে যাওয়া বাঁশ, টিন, টেলিভিশন, রিমোট, হাঁড়ি-পাতিল ও বিভিন্ন আসবাবপত্রের অবশিষ্টাংশ বস্তিটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। সবাই যার যার জিনিস কুড়িয়ে নিচ্ছেন। যেন ছাইয়ের মধ্যে আবারো সোজা হয়ে দাঁড়ানোর পথ খুঁজছেন তারা।
দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে এই বস্তিতেই বাস করছিলেন ষাটোর্ধ্ব শাহজাহান। দীর্ঘদিনের দিনমজুরের আয় থেকে বস্তিতে সাতটি ঘর করেছিলেন। যেগুলো ভাড়া দিয়ে সাতজনের সংসার চলছিল তার।
আগুন যখন লাগে, তখন বস্তিতে ছিলেন না শাহজাহান। গ্রামের বাড়ি শরিয়তপুরে গিয়েছিলেন তিনি। অগ্নিকাণ্ডের খবর শুনে ফিরে এসে দেখেন কিছু নেই। টিভি, ফ্রিজ থেকে শুরু করে ঘরের সবই পুড়ে গেছে। এখন পোড়া ভিটার উপর দাঁড়িয়েই ধ্বংসাবশেষগুলো গুছিয়ে রাখছেন।
শাহজাহান বলেন, জমানো টাকা তেমন নেই। সরকারের সাহায্যের অপেক্ষায় আছি। যদি সাহায্য পাই তো ভাল। না পেলে কোনো রকম একটা ঘর বানিয়ে আপাতত মাথা গোঁজার ঠাঁই করবো।
নিজ ভিটার সামনে মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলেন আলেয়া বেগম। তার স্বামী ইসমাইল মিয়া একজন দিনমজুর। চার মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে সালমার বিয়ের কথাবার্তা চলছিল। কিন্তু এর মধ্যেই আগুনে সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
কাঁদতে কাঁদতে আলেয়া বেগম বলেন, ‘একটু একটু কইরা চাইর বছরে দুই লাখ টেকা জমাইছিলাম। আগুন লাগার পর জান বাঁচাইতে গিয়া হেই টেকাডাও বাইর কইরা আনতে পারি নাই, পুইড়া ছাই হইয়া গেছে। এহন কেমনে নতুন ঘর বাধুম, কেমনে মাইয়া বিয়া দিমু। এর থেইক্কা ভালো ছিল আগুনে পুইড়া মইরা গেলে!’
দু’দিন ধরে স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী মোল্লার দেয়া খাবার খেয়ে থাকছেন পুড়ে যাওয়া বস্তিবাসী। যতোদিন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে না ততদিন পর্যন্ত তিনবেলা বস্তিবাসীর খাবারের দায়িত্ব নিয়েছেন এই সংসদ সদস্য।
এদিকে বস্তিতে ক্ষতিগ্রস্তদের দেখতে এসে মঙ্গলবার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ১০০ টন চাল ও ১০ লাখ টাকা সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে গেছেন।
বস্তিবাসীদের জন্য তাদের স্থায়ী আবাসন করতে সরকার বাউনিয়ায় বিরাট এলাকাজুড়ে পুনর্বাসনের জন্য ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে বলেও জানান কাদের।
প্রসঙ্গত, গত ১২ মার্চ সোমবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে রাজধানীর মিরপুর ১২ নম্বরে ইলিয়াছ আলী মোল্লা বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ২১টি ইউনিটের চেষ্টায় সকাল ৭টা ২২ মিনিটের দিকে ওই আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এঘটনায় দগ্ধ এক বৃদ্ধা বুধবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, বস্তিটিতে আট হাজারের বেশি ঘর ছিল। যতটুকু ধারণা করা যাচ্ছে- ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ঘর পুড়ে গেছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন