কদরুদ্দীন শিশির
স্বল্প উন্নত দেশ (এলডিসি) এর তালিকা থেকে বের হওয়ার জন্য জাতিসংঘের ঠিক করে দেয়া বেশ কিছু শর্ত রয়েছে। এর প্রাথমিক পর্যায় হলো- নিচের তিনটি শর্তের যে কোনো দুইটি পর পর তিন বছর ধরে পূরণ করতে পারা। তিনটি শর্ত হল-
১. মাথাপিছু আয় ১২৩০ ডলার বা তার উপরে হতে হবে।
২. মানবসম্পদ সূচক ৬৬ বার তার উপরে হতে।
৩. অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক ৩২ বা তার নিচে হতে হবে।
এই তিন শর্ত টানা তিন বছর পূরণ করে চলার পর ধরে নেয়া হয় যে এখন একটি দেশ এলডিসি তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
কিন্তু তারপরও শর্ত আছে। এই ধারাবাহিকতা আরও ছয় বছর ধরে রাখতে হবে। প্রতি তিন বছর পর পর সিডিপি কমিটির বৈঠকে খতিয়ে দেখা হবে গত তিন বছর ঠিক মতো শর্ত পূরণ হয়েছে কিনা?
বাংলাদেশ চলতি মার্চ মাসে উপরের তিনটি শর্তই প্রথমবার একসাথে পূরণ করতে পেরেছে। এই পূরণ করতে পারার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে শুক্রবার।
এইসব তথ্য জাতিসংঘের ওয়েবসাইটের এই লিংকগুলোতে গেলে পাওয়া যাবে।
https://www.un.org/development/desa/dpad/wp-content/uploads/sites/45/LDC_profile_Bangladesh.pdf
https://www.un.org/development/desa/dpad/least-developed-country-category/ldc-graduation.html
তিনটি শর্ত পূরণ করার পর (দুইটি পূরণ করলেও চলতো) এখন বাংলাদেশের কাজ হলো আগামী ছয় বছর, অর্থাৎ ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখা। তাহলে ওই বছর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হলে সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশ ‘উন্নয়নশীল দেশ’ এর মর্যাদা পাবে কিনা? সব ঠিকঠাক থাকলে পেয়ে যাওয়ারই কথা।
কিন্তু কোনোভাবেই গতকাল শুক্রবারের চিঠির বিষয়টিকে ‘উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেল বাংলাদেশ’ বলার কোনো সুযোগ নেই। যদি আজ বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সংবাদমাধ্যমের ওয়েবসাইটে এভাবেই সংবাদটিকে উপস্থাপন করা হয়েছে। কোনো কোনো নিউজ পোর্টালের রিপোর্টের শিরোনাম, ইন্ট্রো ও বডিতে পরস্পর বিরোধী তথ্য/বক্তব্য রয়েছে। এতে বিভ্রান্তি আরও বেড়েছে। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি--
এনটিভি অনলাইন শিরোনাম করেছেন, “উন্নয়নশীল দেশ হলো বাংলাদেশ”। সাথে শোল্ডার হিসেবে দেয়া হয়েছে “আনুষ্ঠানিক চিঠি হস্তান্তর”। এটি বিভ্রান্তিকর। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হয়নি, হওয়ার ‘মহাসড়কে’ উঠেছে মাত্র; লক্ষ্যে পৌঁছাতে এখনও কমপক্ষে ছয় বছর বাকি আছে।
রিপোর্টের ভেতরে লেখা হয়েছে--
“স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নাম লেখালো বাংলাদেশ। স্থানীয় সময় শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ত্রিবার্ষিক বৈঠক শেষে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) এ সিদ্ধান্ত নেয়। একই দিন সন্ধ্যায় বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ সংক্রান্ত চিঠি স্থায়ী প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তর করা হয়।”
শিরোনামকে জাস্টিফাই করা হয়েছে এখানে। কিন্তু পরের প্যারায়ই উদ্ধৃত করা হয়েছে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেনকে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রথম বারের মতো যে এলডিসি (স্বল্পোন্নত) ক্যাটাগরি থেকে উত্তীর্ণ হওয়া যোগ্যতা অর্জন করল, তিনটি ক্রাইটেরিয়া ছিল আপনারা জানেন। তিনটা ক্রাইটেরিয়াতে প্রচুর মার্জিনের সাথে বাংলাদেশ ভালো করেছে।’
স্থায়ী প্রতিনিধি কিন্তু ‘উন্নয়নশীল দেশ হলো বাংলাদেশ’ বা ‘উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নাম লেখালো’ এসব কিছু বলছেন না। তার দেয়া তথ্য হচ্ছে ‘এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করল’। অর্থাৎ, সেই একই কথা উন্নয়নশীল হওয়ার পথে উঠেছে মাত্র।
স্ক্রিনশট--
দৈনিক জনকণ্ঠ তাদের ওয়েবসাইটে শিরোনাম করেছে “বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যোগ্যতা অর্জন”। এটা ঠিক আছে। কিন্তু ইন্ট্রোতে লিখেছে, “স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ।” শিরোনামের সাথে এটি মিলছে না!
আরও মজার বিষয় লক্ষ্য করুন পরের লাইনে। তাতে বলা হয়েছে, “এর মধ্য দিয়ে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ের পথে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হল। আগামী ২০২৪ সালে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক উত্তরণ ঘটবে।”
‘উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ের পথে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু’ হয়ে থাকলে রিপোর্টের প্রথম বাক্যে ‘স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ’ লেখার মানে কী?! শিরোনাম, ইন্ট্রোর প্রথম বাক্য এবং পরের বাক্য সবগুলো পরস্পরবিরোধী।
স্ক্রিনশট-
চ্যানেল আই অনলাইনের শিরোনাম “বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ ঘোষণা”। ইন্ট্রোতে বলা হয়েছে, “জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৯৯তম জন্মদিনে বাংলাদেশের জন্য আরেকটি সু-খবর এলো জাতিসংঘের কাছ থেকে। স্বল্পন্নোত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে অাসার ঘোষণা দিয়েছে সংস্থাটি।”
আরেক প্যারা লেখা হয়েছে- “এতদিন ধরে যে দেশ স্বল্পন্নোত দেশের কাতারে ছিল মহান স্বাধীনতার মাসে সেই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে জাতিসংঘের কাছ থেকে।”
এরপরের আরেকটি প্যারায় লেখা হয়েছে, “১৫ মার্চ বৃহস্পতিবার সিপিডি জাতিসংঘ সদরদপ্তরে এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন সংক্রান্ত ঘোষণা দেয়।”
শিরোনাম ও প্রথম দুই প্যারার সাথে এই এক বাক্যের প্যারাটি সাংঘর্ষিক। প্রথমে সরাসরি স্বীকৃতির কথা বলে এখানে এসে বলা হচ্ছে ‘উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন সংক্রান্ত ঘোষণা’ (যেমনটি জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি বলেছেন)।
স্ক্রিনশট--
এভাবে আরও অনেক প্রতিবেদনে বিভ্রান্তি পরিলক্ষিত হয়েছে। কয়েকটির শুধু শিরোনাম ও স্ক্রিনশট দিচ্ছি এখানে--
কালের কণ্ঠ: স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীলের স্বীকৃতিপত্র পেল বাংলাদেশ
আমাদের সময়: বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি জাতিসংঘের
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের বরাতেও একাধিক পত্রিকায় ‘উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের প্রথম ধাপ’ এর পরিবর্তে ‘উন্নয়শীল দেশের স্বীকৃতি’র খবর প্রকাশিত হয়েছে। কয়েকটির স্ক্রিনশট--
তবে এক্ষেত্রে প্রথম আলো ও বিডিনিউজ রিপোর্টগুলো অপেক্ষাকৃত বিভ্রান্তিমূক্ত ছিল।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন