বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে হাইকোর্ট বেঞ্চ যে চারটি যুক্তিতে জামিন দিয়েছে, সেগুলো খণ্ডন করতে গিয়ে সাবেক সেনা শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সাড়ে তিন বছর সাজা খাটার পর জামিনের উদাহরণ টেনেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
রবিবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী এবং বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দারের বেঞ্চে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিত চেয়ে দুদকের আপিলের আবেদনের ওপর শুনানি হয়।
এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান হাইকোর্টের দেয়া চার যুক্তি খণ্ডানোর চেষ্টা করেন। খালেদা জিয়ার আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী অ্যাটর্নি জেনারেলকে মামলার সংক্ষেপসার পড়তে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলেও তিনি জামিনের বিষয়ে জোরাল কোনো বক্তব্য রাখেননি।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি সহিদুল করিমের বেঞ্চ খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের ওপর শুনানি করে। ১২ মার্চ এক আদেশে বিএনপি নেত্রীকে চার যুক্তিতে চার মাসের জামিন দেয় এই বেঞ্চ।
যুক্তিগুলো হলো, খালেদা জিয়ার কম সাজা হওয়া, বিচার চলাকালে জামিনে থাকা অবস্থায় তিনি জামিনের অবপ্যবহার করেননি, তিনি একজন বয়স্ক নারী যার শারীরিক নানা সমস্যা রয়েছে এবং এই মামলায় আপিল শুনানির জন্য পেপারবুক এখনও প্রস্তুত হয়নি।
এই আদেশের বিরুদ্ধে ১৪ মার্চ আপিল বিভাগে শুনানি করে রাষ্ট্রপক্ষ এবং দুদকের আইনজীবী। সেদিন রবিবার অবধি জামিন স্থগিত করেন প্রধান বিচারপতি। আর ১৫ মার্চ দুদক খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিত চেয়ে আপিলের আবেদন করে।
এই আবেদনের ওপরই শুনানি হয় আজ। আর শুনানি শেষে সোমবার আদেশের জন্য দিন ঠিক করে আপিল বিভাগ। এই শুনানির এক পর্ায়ে জামিনের বিরোধিতা করতে গিয়েই সাবের সেনা শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সাজার বিষয়টি টানেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
খালেদা জিয়াকে যে চারটি যুক্তিতে জামিন দেয়া হয়েছিল তার একটি হলো তিনি কম সাজা পেয়েছেন। এই যক্তি খণ্ডন করে অ্যাটর্নি জেনারেল সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের জনতা টাওয়ার মামলায় পাঁচ বছরের সাজা হওয়ার পর সাড়ে তিন বছর সাজার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘উনিও (এরশাদ) জেলও খেটেছেন’।
১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো এরশাদের পাঁচ বছরের সাজা হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। সাড়ে তিন বছর পর ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি জামিনে মুক্তি পান।
অ্যাটর্নি জেনারেল যা বললেন
শুরুতে এই আপিল আবেদন নিয় কথা বলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। তার বক্তব্য শেষে এ পর্যায়ে অ্যাটির্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘আমি সারসংক্ষেপ বলতে চাই।’
মামলার বিস্তারিত পড়া শুরু করলে খালেদা জিয়ার আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলী আপত্তি তুলে বলেন, ‘এখন তো আপিলের শুনানি হচ্ছে না। মামলার সারবত্ত্বায় (মেরিট) যাওয়ার দরকার কী?’
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘আমরা মামলাটি একটু ভালো করে শুনি। আপনারাই বলেছেন, আমরা গতদিন শুনি নাই। আমরা আপনাদের কথা পরে শুনব।’
এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল সারসংক্ষেপ তুলে বলেন, ‘বিচারিক আদালতের রায়ে একজন সাক্ষীর মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে, এতিমখানার টাকা উত্তোলনে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার অনুমোদন ছিল। এর মধ্যে তারেক রহমান ও তার ভাগ্নে মুমিনুর রহমান চার লাখ টাকা তুলে নিয়েছে। তারা কীভাবে এটাকা তুলে নিল?’।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এটা কি ব্যক্তি নামে ছিল?’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘হ্যাঁ, ব্যক্তি নামে ছিল।’
‘এফডিআর করা নিয়ে একটা মামলাও হয়। কীভাবে বিদেশ থেকে টাকা এলো, কীভাবে এফডিআর হলো। তারা জমি কেনার জন্য টাকা দিয়েছিল, কিন্ত যখন জমি পাচ্ছিল না তখন তারা জমির জন্য চাপ না দিয়ে টাকা ফেরত চেয়েছে।’
প্রধান বিচারপতি জানতে চান, ‘মামলাটি কখন হয়েছিল’।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘২০০৮ সালে হয়।’ পরে তিনি বিচারের ধারাবাহিক বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘বিচার বিলম্বিত করতে তারা এমন কোন পথ নেই যে অবলম্বন করেননি। এ মামলা যেন বাস্তবে না আসে সেজন্য তারা বেশ কয়েকবার উচ্চ আদালতে বিভিন্ন অজুহাতে আসেন। এটা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগেও গড়ায়। এ হলো তাদের আচরণ।’
মামলার নথি থেকে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার অজ্ঞাতে টাকা এসেছে বা তোলার বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না, এটা ঠিক না।’
খালেদা জিয়া বিচারিক আদালতের জামিনের অপব্যবহার করেনি এ যুক্তির বিপরীতে মাহবুবে আলম বলেন, ‘এখন তিনি (খালেদা জিয়া) দণ্ডিত। এটা এখন বিচারাধীন। একই যুক্তি এখানে প্রযোজ্য হবে না।’
খালেদা জিয়া একজন বয়স্ক নারী এবং তার শারীরিক নানা সমস্যা হয়েছে-জামিন দেয়ার এই যুক্তির বিপরীতে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘খালেদা জিয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং বয়স্ক নারী। এ বিবেচনায় তাকে ১০ বছরের সাজা না দিয়ে পাঁচ বছরের সাজা দিয়েছেন বিচারিক আদালত। একজন আসামিকে কতবার এই সুবিধা দেয়া হবে?’
‘এখানে ফৌজদারী কাযবিধির ৪৯৭ ধারা প্রযোজ্য হবে ৪২৬ ধারা নয়।... রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় দয়া এবং বার বার অনুকম্পা দেখানো ঠিক হবে না। কোন রাষ্ট্রেই এটা দেখানো হয়নি।’
‘খালেদা জিয়াকে অসুস্থ বলা হচ্ছে কিন্ত তিনি মিটিং করছেন, সমাবেশ করছেন, বিদেশ যাচ্ছেন সবকিছু করছেন। আজকে যদি জামিন দেয়া হয় তাহলে আপিলের শুনানি অনিশ্চিত হয়ে যাবে।’
এ সময় প্রধান বিচারপতি ভারতের বিহারের রাজনীতিক লালুপ্রসাদ ইয়াদবের মামলার বিষয়ে বলেন, ‘লালুপ্রসাদের সঙ্গে কি এ ঘটনার মিল আছে?’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টেও তার (লালুপ্রসাদ) জামিন খারিজ হয়েছিল।’
পেপারবুক তৈরি না হওয়ার যুক্তির বিপরীতে অ্যাটর্নি জেনারেল বলে, আপিল শুনানি শুরু না হওয়া অবধি জামিন হবে, এটা অযৌক্তিক। আমাদের এ কোর্টে বিডিআর মামলায় ১৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। আমরা হাজার হাজার পৃষ্ঠার পেপারবুক তৈরি করেছি।
দুদকের আইনজীবীর যা বললেন
শুনানির শুরুতেই দুর্নীতি দমন কমিশনের(দুদক) আইনজীবী ৪৬ ডিএলআর থেকে একটি রায়ের অংশ পড়ে শুনিয়ে বলেন, একটি মাদক দ্রব্য আইনের মামলায় দুই বছরের সাজা হয়েছিল একজনের। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ তাকে জামিন দেননি।
‘হাইকোর্টে আমরা এই যুক্তি দেখিয়েছিলাম। হাইকোর্ট গ্রহণ না করে সাংঘর্ষিক আদেশ দিয়েছেন।’
বিচারিক আদালতের দেয়া জামিনের অপব্যহার করেননি খালেদা জিয়া-হাইকোর্টের এই যুক্তির বিপরীতে দুদকের আইনজীবী বলেন, ‘তিনি (খালেদা জিয়া) বিচারিক আদালতের অনুমতি না নিয়েই বিদেশে গেছেন। কাজেই হাইকোর্টের এই যুক্তি সঠিক নয়।’
খালেদা জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার বিষয়ে খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘এখানে তিনি চিকিৎসকদের কোন কাগজপত্র দেননি।’
‘তিনি বয়স্ক মহিলা এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ, একারণে বিচারিক আদালত ১০ বছরের সাজা না দিয়ে পাঁচ বছরের সাজা দেয়া সমীচিন মনে করেছে।...তিনি একই সুবিধা দুইবার পেতে পারেন না।’
এ সময় প্রধান বিচারপতি জানতে চান, এই যুক্তি বিচারিক আদালতও গ্রহণ করেছে কি না। জবাবে খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘হ্যাঁ, গ্রহণ করেছেন। ১০ বছরের সাজা না দিয়ে পাঁচ বছরের সাজা দেয়া হয়েছে।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘পাঁচ বছরের সাজা দেয়ায় উনার (খালেদা জিয়া) শারীরিক অবস্থা কি ভাল হয়ে গেছে?’
খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘এ মামলায় রায়ের আগে ও পরে দুই মাস ২৫ দিন যাবত কারাগারে আছেন। হাইকোর্টে উনাকে চার মাসের জামিন দিয়েছেন। এ সময়ের মধ্যে পেপারবুক প্রস্তুতের নির্দেশ দিয়েছেন। পেপারবুক প্রস্তুত হলে শুনানি হোক। সে পর্যন্ত তিনি জেলে থাকুক। আপিল নিষ্পত্তি হলে তিনি আবার জামিন আবেদন চাইতে পারবেন।’
প্রধান বিচারক জানতে চান, ‘উপমহাদেশে জয়ললিতা, লালুপ্রসাদ যাদব কতদিন কারাগারে ছিলেন?’
খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘জয়ললিতার দুর্নীতি মামলায় বিচারিক আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে, সুপ্রিম কোর্টেও এ রায় বহাল ছিল। তার সহযোগী শশীকলা এবং অন্য আরেকটি মামলায় লালু প্রসাদ যাদব এখনো কারাগারে আছেন। কাজেই দুই মাস ২৫ দিনের মধ্যে জামিন পাবেন এট ঠিক হবে না।’
খালেদার আইনজীবী যা বললেন
বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবী হিসেবে আদালতে যুক্তি দেন এ জে মোহাম্মদ আলী। তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের করা মামলায় বিচারিক আদালতে ১০ বছরের সাজা হওয়া বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্র মশিউর রহমানের (ঝিনাইদহ) জামিন পাওয়ার উদাহরণ দেন।
মোহাম্মদ আালী বলেন, ‘আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় হাইকোর্ট জামিন দিতে পারে নাও দিতে পারে। তবে জামিন দেয়াটাই স্বাভাবিক। লঘুদণ্ডের কারণে হাইকোর্ট জামিন দিয়েছেন। জামিন না দেয়ার নজির খুবই কম।’
‘সাধারণত দেখা যায়, আপিল বিভাগ হাইকোর্টের জামিনের ব্যপারে হস্তক্ষেপ করে না।’
ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন