চলতি ২০১৮ সালকে বলা হচ্ছে নির্বাচনী বছর। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে এই বছরের ডিসেম্বর মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। আর নির্বাচনের বছর মানেই অর্থ পাচারের বছর। কারণ অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই দেশ থেকে মুদ্রা পাচারের পরিমাণ বেড়ে যায়। বেড়ে যায় ডলারের মূল্যমানও। কারণ এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ী মনে করে, নির্বাচনে কোন পার্টি সরকারের গঠন করবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
নির্বাচিত সরকার যদি তাদের সমর্থিত সরকার না হয়, তাহলেই বিপদ। তাই নিজেদের অর্জিত অবৈধ অর্থ তারা দেশ থেকে পাচার করে দেয়া শুরু করে। বিশেষ যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তাদের সমর্থক গোষ্ঠী এই অর্থ পাচারে বেশি জড়িত বলে মনে করা হয়।
নির্বাচনকে সামনে রেখে মুদ্রা পাচারের ঘটনা ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। স্বয়ং অর্থমন্ত্রী আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন, এ বছর মুদ্রা পাচারের ঘটনা ঘটতে পারে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফল পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, কটন আমদানির নামে মুদ্রা পাচারের ঘটনা ঘটছে। জানুয়ারি মাসে অর্থনীতি নিয়ে তাদের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘চলতি অর্থবছর জুলাই-ডিসেম্বর প্রান্তিকে কটন আমদানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭৫ ভাগ। এটি একটি চিন্তার বিষয়। কারণ যে হারে কটন আমদানি হয়েছে সে হারে তা তৈরী পোশাক খাতে অবদান রাখেনি। এ ক্ষেত্রে দেখতে হবে কটন আমদানির নামে মুদ্রা পাচার হচ্ছে কি না।’ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের বিরুদ্ধেও মুদ্রা পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানটি বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেছেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেয়া ব্যাংকগুলোর বেশ কয়েকটি থেকে বিদেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে। এ বিষয়ে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
বাংলাদেশের আরেক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর গণমাধ্যমকে বলেছেন, দেশ থেকে প্রচুর অর্থ পাচার হচ্ছে। তার নজির ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। এই অর্থ পাচারের ঘটনাটি ঘটছে আমদানি-রফতানি মাধ্যমে, যেটি করা হয় ওভার ইনভয়েস ও আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে। নির্বাচন সামনে রেখে এই পাচার আরো বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
টাকা পাচার নিয়ে বিশ্বব্যাপী বড় গবেষণার কাজটি করে গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই)। তাদের হিসাবে গত দশ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা, বা ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ডলার। প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে ৪৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বর্তমান খরচ অনুযায়ী যা দিয়ে দেড়টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব।
গত জুনে প্রকাশিত সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে টাকা পাচারের পরিমাণ বাড়ছে। গড়ে প্রতি বছর ৪০০ কোটি থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। গত বছরের শেষে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশী নাগরিকদের জমা টাকার পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক জরিপে দেখা যায়, প্রবাসীরা বিদেশ থেকে দেশে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠান তার ৪০ শতাংশ আসে ব্যাংকিং চ্যানেলে। বাকি ৬০ শতাংশের মধ্যে ৩০ শতাংশ আসে সরাসরি প্রবাসী বা তাদের আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে নগদ আকারে। আর বাকি ৩০ শতাংশ আসে হুন্ডির মাধ্যমে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিদেশ থেকে বাংলাদেশে মোট দেড় হাজার কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। হিসাব অনুযায়ী এর মধ্যে হুন্ডির মাধ্যমে এসেছে প্রায় ৪৫০ কোটি ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এর মাধ্যমে দেশ থেকে বৈদেশিক সম্পদ পাচার হয়ে যাচ্ছে। এখন তো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অবৈধভাবে দেশে রেমিট্যান্স নিয়ে আসা হচ্ছে।
বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের বিষয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে উল্লেখ করা হয়, ১৯৯৪ সালে ১০৬ কোটি ডলার, ১৯৯৬ সালে ১৮২ কোটি ৩০ লাখ ডলার, ১৯৯৮ সালে ১২২ কোটি ডলার, ২০০০ সালে ১১৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার, ২০০১ সালে ১৬৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার, ২০০২ সালে ১৪৩ কোটি ১৬ লাখ ডলার, ২০০৬ সালে ৮৯ কোটি ১০ লাখ ডলার এবং ২০০৭ সালে ১৩২ কোটি ৮০ লাখ ডলার পাচারের কথা বলা হয়েছে।
মালয়েশিয়ান সরকারের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সে দেশের সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকা। মালয়েশিয়ার সরকার বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে ২০০২ সালে চালু করে ‘মাই সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচি। বর্তমানে এ তালিকায় শীর্ষে রয়েছে চীন এবং দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। তিন হাজারের বেশি বাংলাদেশী মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় আবাস গড়েছেন। এতে তারা বিনিয়োগ করেছেন প্রায় চার হাজার কোটি টাকা যা বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়েছে। এ তালিকায় আছেন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলা।
বাংলাদেশ থেকে টাকা নিয়ে কিছু ব্যবসায়ী কেনিয়ায় বড় বড় গার্মেন্ট শিল্প স্থাপন করেছেন। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ব্রিটেন ও থাইল্যান্ডে হোটেল ব্যবসা করছেন।
বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের অধিকাংশের গন্তব্যস্থল সুইস ব্যাংক। কারণ এই ব্যাংকের নিñিদ্র নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার কারণে মানুষ এই ব্যাংকে অর্থ রাখতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হয়েছিল, এই ব্যাংকে কোন কোন বাংলাদেশীর অর্থ রয়েছে তার হদিস বের করা। সেই অনুযায়ী সুইস ব্যাংকের কাছে কয়েক দফা পত্রও পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এ বিষয়ে সুইস ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তাই অধরাই থেকে যাচ্ছে কালো টাকা উদ্ধারের প্রচেষ্টা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন