লেখক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টার নেপথ্যে কারিগরের নাম বেরিয়ে এসেছে। হামলাকারী ফয়জুর রহমান ওরফে ফয়জুল জানিয়েছে, কুয়েতপ্রবাসী চাচা আব্দুল জাহার বিভিন্ন প্রলোভন দিয়ে উগ্র মতাদর্শের দিকে নিয়ে যায়। হামলাকারী ফয়জুলের দুই চাচা আবদুল জাহার ও আবদুল সাদিক ২০ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের কুয়েতে বসবাস করছেন। তার ভাই আবুল হাসানও ছয় মাস আগে কুয়েত যান। এলাকাবাসীরা জানান, দুই চাচা মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে সালাফি মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে পড়েন। তারপর থেকেই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে উগ্রভাব দেখা দেয়। বিভিন্ন কায়দায় এই দুই চাচা বিশেষ করে আব্দুল জাহার ফয়জুরের পরিবারকে উগ্রবাদে প্রভাবিত করতে থাকে।
এলাকাবাসীর ভাষ্য মতে, তার কুয়েতপ্রবাসী দুই চাচার প্রভাবে পুরো পরিবার আহলে হাদিস বা সালাফি মতবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। এমনকি পরিবারের সদস্যরা মসজিদে ভিন্ন পদ্ধতিতে নামাজ পড়তে শুরু করে। জানা যায়, এর আগে গ্রামের বাড়ির মসজিদে ভিন্ন পদ্ধতিতে নামাজ আদায় করতে গিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের তোপের মুখে পড়েছিল ফয়জুর। একপর্যায়ে তাকে ও তার চাচাকে মসজিদ থেকে বের করে দেওয়া হয়।
ইতোমধ্যে আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে ড. জাফর ইকবালকে হত্যা পরিকল্পনার বিষয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছে হামলাকারী ফয়জুর। হত্যার উদ্দেশ্য নিয়েই হামলা চালিয়েছিল বলে স্বীকার করে সে। এ স্বীকারোক্তিতেই সে জানিয়েছে, কুয়েতপ্রবাসী চাচা আব্দুল জাহার বিভিন্ন প্রলোভন দিয়ে উগ্র মতাদর্শের দিকে নিয়ে যায়। এ ছাড়াও জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়াসহ হামলার পরিকল্পনার খুঁটিনাটি তথ্যও জানিয়েছে হামলাকারী।
ফয়জুরের জবানবন্দির বরাত দিয়ে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) আব্দুল ওয়াহাব জানান, কুয়েতপ্রবাসী চাচা আব্দুল জাহার বিভিন্ন প্রলোভন দিয়ে ভাতিজা ফয়জুরকে উগ্র মতাদর্শের দিকে নিয়ে যায়। চাচার দেওয়া ল্যাপটপেই ইউটিউবে নিয়মিত উগ্রপন্থী ওয়াজ শুনত ফয়জুর। জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে কয়েকজনের পরামর্শে সে হত্যা পরিকল্পনাটি সাজায়। গত রোববার বিকালে সিলেট মহানগর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তৃতীয় আদালতের বিচারক হরিদাস কুমারের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব কথা জানায় ফয়জুর। জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টায় আরও কয়েকজন জড়িত বলেও আদালতকে জানিয়েছে সে।
জবানবন্দিতে ফয়জুর আরও জানায়, পরিকল্পনা অনুযায়ী, সে জাফর ইকবালকে হত্যার উদ্দেশে হামলা করে। তবে তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোনো জঙ্গি সংগঠনের যোগাযোগ নেই বলে পুলিশের দীর্ঘ তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।
ফয়জুর আদালতকে আরও জানিয়েছে, জাফর ইকবালের লেখা ‘ভূতের বাচ্চা সুলায়মান’ নামের একটি বই পড়ে সে ক্ষিপ্ত হয়। হামলার সময় সে একাই ছিল বলে আদালতকে জানায়। জিন্দাবাজারের রাজা ম্যানশনের কম্পিউটারের দোকানে চাকরি করার সময় তাকে পরিচিত একজন জঙ্গিবাদ সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্ট ও জঙ্গিবাদের কয়েকটি ওয়াজসহ একটি মেমোরি কার্ড দেয়। জবানবন্দিতে মেমোরি কার্ড দেওয়া ব্যক্তির নামও বলেছে ফয়জুর।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জালালাবাদ থানার ওসি শফিকুল ইসলাম বলেন, হামলার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে যারা উৎসাহিত করেছে তাদের কয়েকজনের নাম আদালতকে জানিয়েছে ফয়জুর। হামলার পর ড. জাফর ইকবাল সম্পর্কে তার ধারণা পাল্টে গেলে সে এ ঘটনার জন্য অনুতপ্ত হয়। নিজের ভুল বুঝতে পেরে সে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
তিনি আরও জানান, ফয়জুরের সঙ্গে অন্য কোনো জঙ্গি সংগঠনের যোগাযোগের তথ্য পাওয়া যায়নি। তার কুয়েতপ্রবাসী চাচাই মূলত, তাকে জঙ্গিবাদে জড়াতে উৎসাহিত করেন।
ফয়জুরের বন্ধু সোহাগ রিমান্ডে
অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারী ফয়জুর হাসানের বন্ধু সোহাগ মিয়াকে সাত দিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত। গতকাল সোমবার দুপুরে সিলেট মুখ্য মহানগর হাকিম সাইফুজ্জামান হিরোর আদালতে হাজির করা হলে শুনানি শেষে তিনি এ আদেশ দেন।
আদালত পুলিশের সহকারী কমিশনার অমুল্য কুমার চৌধুরী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
গত ৩ মার্চ বিকালে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে এক অনুষ্ঠান চলাকালে ফয়জুর হাসান ওরফে শফিকুর জাফর ইকবালের ওপর হামলা চালান। এ ঘটনায় ফয়জুরসহ অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে পরদিন সিলেটের জালালাবাদ থানায় মামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
অমুল্য বলেন, ফয়জুরকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করার অভিযোগে সোহাগকে গত রোববার রাতে সিলেট নগরীর কালীবাড়ি এলাকা থেকে আটক করে পুলিশ। তার সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করলে শুনানি শেষে আদালত মঞ্জুর করেন।
সোহাগ মিয়ার বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে। তার বাবার নাম সাদিকুর রহমান। ২৪ বছর বয়সী সোহাগের কাছে থেকে ফয়জুরের ব্যবহৃত একটি কম্পিউটারও জব্দ করা হয়েছে বলে অমুল্য জানান।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন