এমপিও ভুক্তিকরণ, একাডেমিক ও চাকরি পরীক্ষার ফরম পূরণ, অর্থনৈতিক লেনদেন, পাসপোর্ট, ভূমি জরিপসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখন ভোগান্ত্মি ও অনিয়মের মুখে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। অনেক ক্ষেত্রে সমস্যার কারণ সম্পর্কেও জানতে পারছেন না তারা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোন নিয়মে অনলাইনে সরকারি সেবা পেতে হবে সে সম্পর্কে সঠিক গাইডলাইনও নেই।
সরকারি সেবা সহজে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর লক্ষ্যে অনলাইনে কার্যক্রম বাড়িয়েও ভোগান্ত্মি ও দুর্নীতি রোধ সম্ভব হচ্ছে না। বরং এতে উল্টো অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। ফলে সমস্যা সমাধানের বদলে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। অনলাইননির্ভর বেশিরভাগ সরকারি সেবায় ভোগান্ত্মি ও অনিয়মের শিকার হচ্ছেন সাধারণ সেবা গ্রহীতারা।
এমপিওভুক্তিকরণ, একাডেমিক ও চাকরি পরীক্ষার ফরম পূরণ, অর্থনৈতিক লেনদেন, পাসপোর্ট, ভূমি জরিপসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসব ভোগান্ত্মি ও অনিয়মের মুখে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। অনেক ক্ষেত্রে সমস্যার কারণ সম্পর্কেও জানতে পারছেন না তারা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোন নিয়মে অনলাইনে সরকারি সেবা পেতে হবে সে সম্পর্কে সঠিক গাইড লাইনও নেই ওয়েবসাইট ও সেবা প্রদান সেন্টারগুলোতে। ফলে এসব নিয়ম-কানুন জানানোর জন্য এক শ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগীর আবির্ভাব হয়েছে। যাদের কারণে-অকারণে উৎকোচ দিতে হচ্ছে। পাশাপাশি সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্তরা সাধারণ মানুষকে সহায়তা না করার কারণেও ভোগান্ত্মির শিকার হতে হচ্ছে তাদের।
সাধারণ শিক্ষকদের ভোগান্ত্মি ও অবৈধ আর্থিক লেনদেন বন্ধ করার উদ্দেশ্যে প্রায় দুই বছর আগে বেসরকারি শিক্ষকদের এমপিওর (মনথলি পে-অর্ডার) আবেদন অনলাইনে করা বাধ্যতামূলক করে সরকার। কিন্তু বাস্ত্মবে ঘটেছে তার ঠিক উল্টোটা। মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তারা নানা অজুহাতে বারবার অনলাইনে ফরম পূরণ করতে বাধ্য করছে শিক্ষকদের। নির্ধারিত সময়ে ফরম উপজেলা থেকে জেলা, জেলা থেকে আঞ্চলিক অফিস এবং সেখান থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) যাওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা যায় না। আবেদনকারী শিক্ষকরা যখন খোঁজ নিতে যান, তখন তাদের অনলাইন আবেদনে নানা ত্রম্নটি ও সমস্যার কথা বলে ফাঁদে ফেলে টাকা আদায় করা হয়। আবার উপজেলা থেকে জেলা অফিসে যাওয়ার সময় উপজেলা কর্মকর্তা আবেদনকারী শিক্ষককে জেলায় গিয়ে কর্মকর্তাদের সন্তুষ্ট করার কথাও বলে দেন।
মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা অফিসারদের হাত এতটাই প্রশস্ত্ম যে, খোদ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকেও (মাউশি) তাদের কাছে নাকানি-চোবানি খেতে হচ্ছে। পরিস্থিতি পর্যালোচনায় মাউশিতে শিক্ষামন্ত্রীর উপস্থিতিতে এ সংক্রান্ত্ম জরম্নরি সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সে জন্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা শিক্ষামন্ত্রীর কাছে জানতে চান।
সভায় প্রশ্নোত্তরপর্বে শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মনিটরিং) অধ্যাপক ড. সেলিম মিয়া অভিযোগ করেন, অনলাইনে এমপিওভুক্তিতে মাঠপর্যায়ে দুর্নীতি সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। উপজেলা, জেলা ও উপ-পরিচালকের দপ্তরে দুর্নীতি হচ্ছে। এমনকি আমি সুপারিশ করার পরও আমার এক আত্মীয়ের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছে শিক্ষা অফিস।'
এ সময় আরও দুই কর্মকর্তা একই অভিযোগ করেন; কিন্তু ভুক্তভোগী শিক্ষকরা এ বিষয়ে মুখ খুলতে চান না। এমপিও করাতে গিয়ে নিয়মবহির্ভূত অর্থ লেনদেন করেছে বা অন্য কোনো উপায়ে ভোগান্ত্মির শিকার হয়েছে এমন একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা নির্দিষ্ট করে তাদের বিদ্যালয় ও নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলতে রাজি হয়। তাদের অভিযোগ, ওই নির্ধারিত জেলা বা উপজেলায় শিক্ষা কর্মকর্তাদের অধীনেই তাদের যেহেতু কাজ করতে হয় তাই তাদের নাম পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তা তাদের জন্য বিপদের কারণ হবে।
বরগুনা জেলার একটি বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নাম গোপন রাখার শর্তে যায়যায়দিনকে বলেন, গত কয়েক মাস ধরে চেষ্টা করে কয়েক জায়গায় প্রায় ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে এমপিও নিশ্চিত করেছেন। প্রথম অনলাইনে ফরম পূরণ করে উপজেলা অফিসে পঠান। কিন্তু বেশ কিছুদিন হয়ে গেলেও কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসে যোগাযোগ করেন। সেখান থেকে জানানো হয় ফরম অস্পষ্ট। তাই এতে হবে না। পরে আবার অনলাইনে ফরম পূরণ করে দিতে হবে। তখন ফরমের এক স্থান থেকে কমা বাদ পড়েছে দাবি করে তা ঠিক করতে টাকা চাওয়া হয়। তার পরও কাজ হয়নি। এরপর দুইধাপে টাকা দিলে তা জেলা অফিসে যায়। জেলা অফিস থেকে কোন ঝামেলা ছাড়াই বিভাগীয় বা আঞ্চলিক অফিসে যায়। কিন্তু আঞ্চলিক অফিসে যাওয়ার পর আবার টাকা দেয়ার পর তা ডিডিতে যায়।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক ড. মো. আবদুল মান্নান যায়যায়দিনকে বলেন, এমপিওসহ বেশ কিছু বিষয় অনলাইন ও বিকেন্দ্রীকরণের ফলে মাঠ পর্যায়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি আরও প্রসারিত হয়েছে। এটা বন্ধে তারা বেশ কিছু উদ্যোগ নিলেও কিছু ক্ষেত্রে এখনও সফল হতে পারেননি, তবে চেষ্টা করছেন। আশা করছেন খুব শিগগিরই বিষয়গুলো সমাধান করতে পারবেন। আর অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ আদায় করার জন্য স্থানীয় পর্যায়ের কোনো শিক্ষা অফিসার যদি অনিয়ম বা বিলম্বিত করে থাকে তবে তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করলে তারা কঠোর ব্যবস্থা নেবেন।'
পিএসসির অধীন একটি পরীক্ষায় গত বছরের জুলাইয়ে ফরম পূরণ করতে গিয়ে তীব্র ভোগান্ত্মিতে পড়েন পিপাস মিয়া। তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, 'যেখানে যা চাওয়া হয়েছে তার সবকিছু দিয়েই ফরম পূরণ করেও তা সাবমিট করতে অনেক সময় ব্যয় করতে হয়েছে। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চেষ্টা করার পর এক প্রকার হালই ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আবেদনের শেষ তারিখে আর একবার চেষ্টা করি। তখন তা সাবমিট করা সম্ভব হয়। কিন্তু এর আগে কেন বারবার চেষ্টা করেও সফল হয়নি তা আমি জানি না।'
ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রেও এখন অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। সেখানেও সেবা গ্রহীতাদের নানা ধরনের ভোগান্ত্মি পোহাতে হয়। অবৈধ টাকার লেনদেনও করতে হয় আগের মতোই। ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাসুদ রেজওয়ান কিছুটা কৌশলে অনিয়মের কথা স্বীকার করেন। তিনি এ বিষয়ে বলেন, 'অনেকে আছেন ফরম ঠিকমতো পূরণ করতে পারেন না। অনেকে ভুল তথ্য দিয়ে ফরম পূরণ করেন। পরে তা ধরা পড়ার পর সংশোধন করতে গিয়ে ভোগান্ত্মিতে পড়েন এমন অভিযোগ আছে।'
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে অনলাইনভিত্তিক লেনদেন বেশ জোরদার হয়েছে। কিন্তু সে সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়েনি এর নিরাপত্তা। লেনদেনের সময় গ্রাহকের ভুল বা অজান্ত্মে দুষ্কৃতকারীরা তথ্য চুরি করে।
ইসরাত জাহান, সাজিয়া চৌধুরী, অপরূপা চৌধুরী গত ২২ ফেব্রম্নয়ারি থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বনানীর ১১ নম্বর সড়ক ও কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের 'স্বপ্ন' নামক সুপারসপ থেকে অনলাইন ব্যাংক কার্ড ব্যবহার করে কেনাকাটা করেছিলেন। এ সময় তাদের কার্ডের তথ্য জালিয়াতি করে একটি চক্র। পরে সে তথ্য দিয়ে একই রকম নকল কার্ড তৈরি করে তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে নেয় চক্রটি। একই সময়ে বনানীর ওই সুপারসপ থেকে কার্ডের তথ্য চুরি করে অর্ধ শতাধিক ব্যক্তির কার্ডও জালিয়াতি করা হয় এবং একই প্রক্রিয়ায় ২০ লাখ টাকা তুলে নেয় চক্রটি।
এসব গ্রাহক ভিন্ন ভিন্ন ব্যাংকের গ্রাহক বলে পরে জানা যায়। জানতে চাইলে সিটি ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসরম্নর আরেফিন বলেন, বনানীর স্বপ্ন সুপারসপের একটি আউটলেট থেকে এসব কার্ড ক্লোন হয়েছে। এরপর বিভিন্ন এটিএম থেকে টাকা তুলে নিয়েছে। তারা মতিঝিল থানায় মামলা দায়ের করেছেন।
মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত্ম) গোলাম রব্বানী বলেন, কার্ড জালিয়াতি করে টাকা উত্তোলনের ঘটনায় সিটি ব্যাংক একটি মামলা দায়ের করেছে। ঘটনার বিস্ত্মারিত জানতে তদন্ত্ম শুরম্ন হয়েছে।
এর আগে ২০১৬ সালে ফেব্রম্নয়ারিতে বিশেষ ক্যামেরার মাধ্যমে এটিএম থেকে তথ্য সংগ্রহ করে কার্ড জালিয়াতি হয়। তখনও একইভাবে বিভিন্ন গ্রাহকের টাকা তুলে নেয়া হয়।
এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকের গ্রাহকরা প্রায়ই অভিযোগ করেন, অনলাইনে লেনদেন করতে গিয়ে তাদের ভোগান্ত্মির শিকার হতে হয়। অনেক সময় টাকা থাকে না। আবার থাকলেও ভিন্ন ভিন্ন কারণে টাকা উঠানো যায় না।
অনলাইনে সরকারি সেবা নিতে গিয়ে প্রায় সব ক্ষেত্রেই এ ধরনের ভোগান্ত্মি-অনিয়ম ও দুর্নীতি হলেও তা কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ বা পর্যবেক্ষণে সরকারের কোনো একক সেল নেই। প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানকে আলাদা আলাদাভাবে তার প্রতিষ্ঠানের এসব অনিয়ম তদারকি করতে হয়। এ বিষয়ে শিক্ষা, ইমিগ্রেশন, ব্যাংক বা পুলিশ যেখানেই যোগাযোগ করা হয়েছে তারা সবাই নিজেদের দায় এড়িয়ে বক্তব্য দিয়েছে। ফলে ভোগান্ত্মি নিরসনে সাধারণ মানুষের অভিযোগ শোনা বা তার সমাধান করার মতো কোনো একক প্রতিষ্ঠান কার্যত দেশে নেই।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন